বাসা-বাড়ির ছাদে রোদে দেওয়া জামাকাপড় চুরি। সেই চোরাই মাল বিক্রি করতে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর তারা একসঙ্গে চুরি করা শুরু করেন। ২০-২৫ বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দরজা ভেঙে চুরি। এভাবে ৫০ বছর ধরে ৫০০ এর বেশি চুরি করেছে এই চক্রটি।
রোববার (৯ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি জানান, চুরি করার আগের দিন তারা কথা বলে ঠিক করে নিতেন কোথায় কাজ করা হবে। সে অনুযায়ী পরদিন সকালে তারা ওই এলাকায় হাজির হতেন। একসঙ্গে চা পান করার পর হাঁটতে থাকেন এবং খেয়াল করেন কোন বাসায় দারোয়ান ও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। বাসা টার্গেটের পর দুইজন ভেতরে ঢোকেন, বাকি ২-৩ জন বাইরে পাহারায় থাকেন।
দিনের বেলায় রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বহুতল ভবনে দরজা ভেঙে স্বর্ণালংকার এবং টাকা পয়সা চুরি চক্রের সর্দার ও দোকানদারসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
শনিবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর পল্লবী ও তাঁতীবাজার এলাকা এবং গাজীপুরের টঙ্গি থানা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- চোর চক্রের সর্দার মো. জব্বার মোল্লাহ (৬৭), মো. জামাল সিকদার (৫২), মো. আবুল (৫১), আজিমুদ্দিন (৫২), টঙ্গী এলাকার জুয়েলারি দোকান মালিক মো. আনোয়ার হোসেন (৪৪) এবং তাঁতীবাজার এলাকার জুয়েলারি দোকান মালিক মো. আব্দুল ওহাব (৪৫)।
গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় ৯ ভরি স্বর্ণ, ৮২ ভরি রূপা, নগদ প্রায় ১৭ লাখ টাকা, দরজা ভাঙার যন্ত্রপাতি এবং মোবাইলফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে হারুন অর রশীদ বলেন, গত ১৭ আগস্ট খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ-২ এর ১৫নং রোডে চিকিৎসক দম্পতির বাসায় দিনের বেলায় চুরি হয়। দারোয়ান ও সিসিটিভি না থাকার সুযোগে চোর চক্রের সদস্যরা বাসায় ঢুকে ৩য় তলার দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর আলমারির লক ভেঙে ভেতর থেকে ৪২ ভরি স্বর্ণ ও ৪০০০ ইউএস ডলার চুরি করে।
এ ঘটনায় ডিএমপির খিলক্ষেত থানায় মামলা হলে তদন্তে নামে পুলিশ। শনিবার (৮ অক্টোবর) মিরপুর পল্লবী এলাকার একটি বাসায় ঢুকে চুরি করার সময় হাতেনাতে চোর-চক্রের ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
তিনি জানান, চোর চক্রটির সর্দার মো. জব্বার মোল্লাহর বয়স ৬৭ বছর। সাদা পাঞ্জাবি-লুঙ্গি, মাথায় টুপি এই বেশভূষাগুলোই এই চোর চক্রের প্রধান হাতিয়ার। দাড়ি- টুপি-পাঞ্জাবি পরনে থাকায় কোনো অপরিচিত ভবনে উঠলেও প্রাথমিকভাবে কেউ তাদের সন্দেহ করে না। কেউ জিজ্ঞাসা করলে কৌশলে তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দেন।
একটি এলাকা থেকে হাঁটা শুরু করে এবং সুবিধামতো ভবন টার্গেট করে বিভিন্ন ফ্লোরে ঘুরে যে বাসার প্রধান দরজা লক করা থাকে সেই বাসায় বিশেষভাবে তৈরি দেশীয় অস্ত্র দিয়ে দরজা ভেঙে চুরি করেন।
তিনি আরও জানান, ১০ বছর বয়স থেকে তারা কারওয়ান বাজার, মিরপুরসহ সংসদ ভবনের আশপাশের এলাকায় টোকাইগিরি করতেন। এ সময় তারা বাসা-বাড়ির ছাদে রোদে দেওয়া জামাকাপড়, জুতা, রড ইত্যাদি চুরি করে বিক্রি করতেন। চোরাই মাল বিক্রি করতে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং তারা একসঙ্গে চুরি করা শুরু করেন।
গত ২০-২৫ বছর ধরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে চুরি করা শুরু করেন। চুরি করার আগের দিন তারা কথা বলে ঠিক করে নিতেন কোথায় চুরি করা হবে। সেই মোতাবেক পরদিন সকালবেলা তারা ওই এলাকায় হাজির হতেন। এক সঙ্গে চা পান করার পর তারা হাঁটতে থাকেন এবং খেয়াল করে দেখেন কোন বাসায় দারোয়ান ও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই।
বাসা টার্গেটের পর দুইজন বাসার ভেতরে প্রবেশ করে, বাকি ২-৩ জন বাইরে পাহারায় থাকেন। ১০ মিনিটের মধ্যে চুরি শেষ করে মালামাল ভাগ করে নিয়ে যে যার যার এলাকায় চলে যান। পরদিন আবার অন্য কোথাও চুরির পরিকল্পনা করেন। তারা শুধুমাত্র মূল্যবান অলংকার ও বিদেশি কারেন্সি, টাকা ইত্যাদি চুরি করতেন।
তিনি বলেন, চোরাই স্বর্ণালংকার ঢাকার তাঁতীবাজারের দুটি দোকান এবং গাজীপুরের টঙ্গী বাজারের একটি স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। তারা শত শত ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ অন্যান্য অলংকার ও পাথর তাঁতীবাজার এবং টঙ্গী বাজারে বিক্রি করতেন।
তাদের দেওয়া তথ্যে, টঙ্গীবাজারে স্বর্ণের দোকান মালিক মো. আনোয়ার হোসেন (৪৪) ও তাঁতীবাজারে স্বর্ণের দোকান মালিক মো. আব্দুল ওহাবকে (৪৫) চোরাই স্বর্ণ ক্রয়-বিক্রয়ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বর্ণের দোকান মালিকরা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে যে তারা এই স্বর্ণ-সমূহ গলিয়ে ফেলে এবং খুচরা আকারে অন্যান্য দোকান এবং কাস্টমারদের কাছে অতি দ্রুত বিক্রি করে ফেলতেন।
রাজধানীর বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি ভবনে সিসি টিভির ব্যবস্থা করা, দারোয়ান রাখার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া কোনো ব্যবসায়ী যেন চোরাই স্বর্ণ না কেনে সে আহ্বান জানান তিনি।