স্বাধীনতার পর দেশের প্রকৃত গণমুখী কার্যক্রমের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা সবচেয়ে সফল উদ্যোগ। কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এই ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে স্বাস্থ্য সেবা। মা ও শিশুর পাশাপাশি প্রান্তিক জনপদের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এই ক্লিনিক। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তৃণমূলে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভূতপুর্ব ধারণার রুপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি তার স্বকীয় উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল। দেশ-বিদেশের এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের অভিনব ধারণা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার সুবিধাগুলো আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমেই দেশের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, যার ফলে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের জনগণের বিশাল একটি অংশ। অনেক দেশ তৃণমুল পর্যায়ে তাদের স্বাস্থ্য সেবায় এ মডেল অনুকরণ করছে। তৃণমূল স্বাস্থসেবায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ বাংলাদেশের এই কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাটি নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক বাংলাদেশ সফরের সময় গ্রামে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার একটি পুস্তিকার নাম– কমিউনিটি ক্লিনিক- হেলথ রেভ্যুলেশন ইন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগুলো ছিল মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক। অথচ সে সময় ৮৫% মানুষ গ্রামে বাস করতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র ৩ বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু ৭৫ এর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে তিনি সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দিকে আর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই জাতির জনকের কন্যা পিতার স্বপ্ন – ‘সবাই জন্য স্বাস্থ্য সেবা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন।
জন্ম দেন অভিনব ধারণা কমিউনিটি ক্লিনিক । প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৪ হাজার ৪৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়।
২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়।
কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয় তৃণমূলের জনগণের জন্য কল্যাণকর এই সফল স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমটি। বিএনপি-জামাত জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ক্লিনিকগুলো। নষ্ট হয়ে যায় অনেক ভবন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল ক্লিনিকগুলো।
২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম চালু করে। এ সময়ে ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার-সিএইচসিপি নিয়োগ দেওয়া হয়। পরিত্যক্ত ব্যবহার অযোগ্য ভবনগুলো সংস্কার ও নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে। দ্রুত বাড়তে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা।
বর্তমানে ১৪ হাজার ২০০টি ক্লিনিক চালু রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ১৪হাজার ৮৯০টি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
২০১৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার আবারো ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে একটি আইনি কাঠামোতে ঢেলে সাজানো হয়। ২০১৮ সালে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-২০১৮’ নামে একটি আইন করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এটি সংসদে পাশ হয়। আইন পাশের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের প্রজ্ঞাপন হয়। ২০১৮ সালেই ১৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড হয়। এতে একটি উপদেষ্টা পরিষদেরও বিধান রাখা হয়। যার সভাপতি স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
এই আইন ও স্ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের ফলে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাদিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিতের জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রামীণ সড়কের পাশে প্রায়ই চোখে পড়ে একেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় একই নকশায় তৈরি ছোট্ট ভবনে এই ক্লিনিক। গ্রামীণ জনপদের প্রতি ৬০০০ মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক তৈরি করা হয়েছে। ২০ থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটার দুরত্বে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে এমন পরিকল্পনায় ক্লিনিকগুলোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষের দান করা জমিতে এসব ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়।
প্রথম দিকে ৫ শতাংশ জায়গায় ক্লিনিকগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে। এ জন্য এখন ৮ শতাংশ জমির ওপর নতুন মডেলের ক্লিনিক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ভবনে চারটি করে রুম।
দুটি স্বাস্থ্যকর্মীদের বসার জন্য, একটি রোগীদের ওয়েটিং রুম, আরেকটি লেবার (ডেলিভারি) রুম। বাথরুম থাকছে দুটি। আধুনিক মানের একটি ক্লিনিক হিসেবে গড়ে উঠছে প্রত্যন্ত গ্রামের ভেতরের এসব ক্লিনিক। প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টা শেখ হাসিনা নিজেই এর নকশা অনুমোদন করে দিয়েছেন। ক্লিনিক ভবনের সর্বশেষ স্থাপত্যশৈলী খুবই নান্দনিক এবং আকর্ষণীয়
গ্রামের মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিটি চালায় কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্