মিথ্যা মামলায় হয়রানি, গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ও মাদক দিয়ে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায়, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি এবং লুটসহ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণের অভিযোগই সবচেয়ে বেশি। এক শ্রেণির পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরির অভিযোগও রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের নামে জাল মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে চাকরি, মাদক সেবন এবং মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। যৌতুক দাবি ও ধর্ষণের অভিযোগও কম নয়। কিছু কিছু অভিযোগের ক্ষেত্রে মামলা হয়। বেশিরভাগ অভিযোগের ক্ষেত্রে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে বেশিরভাগ অভিযোগই প্রমাণিত হচ্ছে না। সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ঘটনা নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জ থেকে পাওয়া সোয়া দুই বছরের (২০১৯ সালের ২২ মে থেকে চলতি বছরের ২৫ জুলাই পর্যন্ত) প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৫ ভাগ প্রমাণিত হয়েছে। ৬৫ ভাগ অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া যায়নি। নির্ধারিত সময়ে ঢাকা রেঞ্জে এক হাজার ১৩৩টি অভিযোগ এসেছে। এতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা এক হাজার ৩৮৭ জন। এক হাজার ১৩৩টি অভিযোগের মধ্যে এক হাজার ৮২টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। এসবের মধ্যে ৩৮০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ১৫৩টিতে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৮৮টির তদন্ত চলছে।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগ করার সময় দালিলিক তথ্য-উপাত্ত থাকা জরুরি না। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে অবশ্যই দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। তিনি বলেন, পুলিশ সব সময় আইনের মধ্যে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে আইন কারও বিরুদ্ধে গেলে সেই ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে অভিযোগ করতে পারেন। এমন ঘটনায় তদন্তে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) শেরেবাংলা নগর থানার এসআই খায়রুল আলমকে ৩১ আগস্ট গ্রেফতার করে গুলশান থানা পুলিশ। সহকর্মীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত মাসে বাগেরহাটের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এসপি মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা হয়েছে। একই মাসে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে বাসায় নিয়ে সময় কাটানোর অভিযোগে ডিবির এডিসি গোলাম সাকলায়েনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে তাকে ডিবি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০টি স্বর্ণের বার লুটের অভিযোগে ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ১০ আগস্ট মামলা হয়। ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইয়াবা ও টাকা রেখে আসামি ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে তিন কনস্টেবলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১২ আগস্ট ধামরাইয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে এক পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। চলতি বছরের ১ মার্চ কক্সবাজারে এক নারীকে পিস্তল ঠেকিয়ে ৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হন। ২১ আগস্ট যশোর শহরের একটি আবাসিক হোটেল থেকে মোজাহিদ ও আজম মোল্যা নামের পুলিশের দুই সদস্যকে মাদকসহ গ্রেফতার করে পুলিশ।
ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টে (সিআইডি) কর্মরত এসআই সুমাইয়া বেগম লাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ- যৌতুকের দাবিতে তিনি স্বামীকে নির্যাতন করেছেন। এছাড়া ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরিতে যোগদান করেছেন তিনি। পুলিশ ভেরিফিকেশনে সেটি প্রমাণিত হওয়ার পরও তিনি চাকরি পেয়েছিলেন। চাকরিতে যোগদানের পর তার বিরুদ্ধে পরকীয়া ও জবর-দখলসহ নানা অভিযোগ উঠে। গত বছরের ২৫ অক্টোবর লাকীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা হয়। মামলায় ৪ জানুয়ারি ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। সম্প্রতি তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি চাকরি নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। কিন্তু তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিল ভুয়া। ২৪ আগস্ট ওই সনদ বাতিল করে সরকার। কিন্তু এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো এসআই লাকীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সূত্রাপুর থানা পুলিশের এসআই রহমাত উল্লাহ ও এএসআই রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তারা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ইয়াবা দিয়ে সাধারণ মানুষদের ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করেছেন। ২০ জুন তাদের গ্রেফতার করে পল্টন থানা পুলিশ। এ বিষয়ে পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ৩ জুলাই একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন রূপনগর থানার এসআই মুসলিম। পল্লবী থানাধীন ১১ নম্বর সেকশন ৮ নম্বর রোডে ইয়াবা বিক্রি করছিলেন দুই মাদক ব্যবসায়ী। ক্রেতা ছিলেন পুলিশের সোর্স। ক্রেতাকে না ধরলেও ১০ পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে এসআই মুসলিমের নেতৃত্বাধীন একটি টিম। দুই মাদক ব্যবসায়ীর অভিযোগ- গ্রেফতারের পরদিন তাদের কাছ থেকে ৬৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার আ স ম মাহাতাব উদ্দিন যুগান্তরকে জানান, একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারকে ঘটনাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না।
২৩ আগস্ট রাতে রংপুরের সিআইডির এএসপি সারোয়ার কবীরের নেতৃত্বে একটি টিম দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার নান্দেডাই গ্রাম থেকে জহুরা বেগম ও তার ছেলে জাহাঙ্গীরকে অপহরণ করে। পরদিন বিকালে মুক্তিপণের ১৫ লাখ টাকা স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়ার সময় সিআইডির সদস্যরা গ্রেফতার হয়। তারা হলেন- রংপুর জেলা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সারোয়ার কবীর, এএসআই হাসিনুর রহমান ও কনস্টেবল আহসান-উল হক ফারুক। এ বিষয়ে রংপুর সিআইডির ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আতাউর রহমান বলেন, আমার অনুমতি ছাড়া ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে তারা অপারেশনে যায়। তারা আটক হওয়ার পর বিষয়টি জানতে পারি। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুএ যুগান্তর