‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পদার্পণ বিংশ শতাব্দীর ৮০-এর দশকে। ১৯৮৬-৮৭ শিক্ষাবর্ষে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে ১৯৯০ সালে অনার্স ও ১৯৯১ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ফলাফল অবধি আমার ও সমসাময়িক অনেকের পদচারণা ছিল ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। সমাজ বিজ্ঞানে পড়াকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবসিডিয়ারি বিষয়ে ইসলামের ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। সেই সাথে “আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে ইংরেজীতে ডিপ্লোমা করেছি।
১৯৮৭ সালে থেকেই শুরু হলো আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাত বছরের ছাত্রজীবন। অচেনা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঠাঁই হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর। যদিও দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই শুরুতে হলে সিট পাওয়া লটারি জেতার মতই ভাগ্যের ব্যাপার! চেনা গণ্ডির বাইরে এসে যখন হলে উঠতে হয়, সেই পরিস্থিতি অনেকের কাছেই প্রথমে সুখের হয় না। আবার অচেনা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময়ও লাগেনা। বরং বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে এই হলের স্মৃতিই যেন মনকে উতলা করে।
�ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে যখন এ এফ. রহমান হলে একসঙ্গে ২০ জনের গণরুমে উঠেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল কীভাবে হলে থাকব? কিন্তু সেই ২০ জনই যখন বন্ধু হয়ে গেলাম, সারা রাত জেগে হল গেটে, মল চত্তর কিংবা রাজু ভাস্কর্য-টিএসসি আর ফুলার রোডে গান গেয়ে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে শুরু করলাম, তখন বুঝলাম ক্যাম্পাস জীবন কত সুন্দর। যখন জানতে পারলাম, রাজনৈতিক সাহায্য ছাড়া হলে আসন পাওয়া যাবে না, খুব ভেঙে পড়েছিলাম। পরবর্তীতে কিছুদিন ১১১ জসীম উদ্দীন হলেও ছিলাম।.যাহোক, দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই মেধাভিত্তিক বন্টনে আমরা সিট পেলাম নবনির্মিত মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। প্রথমদিনেই পরিচয় হলে সিলেট থেকে যাওয়া একই হলে সিটপ্রাপ্ত বন্ধু দীপুর সাথে এবং সে চলে আসলো ৩১২-তে রুমমেট হয়ে।পর্যায়ক্রমে রুমমেট ছিলেনঃ জহির, বাদল ভাই, আখতার, … সিনিয়র-জুনিয়র মিলে হলের আড্ডা ছিল ছাত্রজীবনের প্রাণ। হলের বন্ধুদের ভুলার নয়।
হলের ডাইনিং-ক্যানটিনের খাবার নিয়েও সবার অনেক মজার গল্প জমা আছে। প্রথমে ডাইনিংয়ের খাবার একদম খেতে পরতাম না। পাতলা ডাল, মোটা ভাত আর প্লাস্টিকের মতো পরোটা। পাতলা ডালের বউলে অনেকেই ভূলবশতঃ হাত ধূয়ে ফেলতেন! তবে সকালের নাস্তায় ডাল, সব্জি ভাজি, ডিম পোচ খুব মজা লাগতো না। আজ সেগুলো আমাদের কাছে সুখকর স্মৃতি হিসেবেই গণ্য।
১৯৯৪ সাল থেকে শিক্ষকতার মাধ্যমে আমার কর্মজীবনের শুরু হয় পথচলা। কিন্তু এ অধ্যায়ে আমার কর্মজীবনই মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার বিদ্যাপীঠ নয়, এ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বহুমাত্রিকতার সূতিকাগার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে এ বহুমাত্রিকতার সামান্য কিছুই আহরণ করে জীবনের একটি বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ সময়কে পার করে দিতে পেরেছি। সে অর্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে এক সার্থক ও সফল মানুষে পরিণত করেছে বলেই দাবি করা যায়।
এরই মধ্যে পরিচিত বন্ধুদের নিয়ে বের হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখব বলে। প্রথমেই দেখতে যাই লাইব্রেরিটা কেমন। দেখি বিরাট লাইব্রেরি! তখনও লাইব্রেরি কার্ড করা হয়নি, তাই ঢুকতে পারলাম না। বহু ছাত্রছাত্রী ঢুকছে, বের হচ্ছে। লাইব্রেরির অদূরে দেখলাম ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন। নানা আন্দোলন সংগ্রামে এ ক্যান্টিনে বসেই অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে। অনেক ছাত্র বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ কেউ চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। পরে দেখেছি এই ‘মধুর ক্যান্টিন’ আরও বেশি বিখ্যাত হয়ে ওঠে সারা বাংলার ছাত্রসমাজের কাছে, পরিণত হয় সকল আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে। জেনেছি, বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলনে মধুর ক্যান্টিন বিশাল ভূমিকা পালন করে। যদিও এটি নাকি এককালে নবাবদের বাগানবাড়ির দরবার কক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরে জেনেছি মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে-দা’কে স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূসহ নির্মমভাবে নিহত হতে হয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে।
মধুর ক্যান্টিনের অপজিট পার্শে ডাকসু ভবন ও ক্যাফেটারিয়া সবসময় ছাত্রছাত্রীদের পদচারনায়, মিছিলে, গগণ বিদারী স্লোগানে মুখরিত থাকতো। ওখান থেকে লেকচার থিয়েটারের পাশ দিয়ে বাণিজ্য অনুষদ হয়ে সূর্য সেন হলের দিকে যাওয়ার পথে ডান পাশে হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল’-বিদেশি ছাত্রদের থাকার জন্য নির্ধারিত হোস্টেল। তখন মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া থেকে অনেক ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলে পড়তে আসত; তাদের থাকার জন্য এ হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয়। এদের কেন্টিনে আমরাও মাঝে মধ্যে নাস্তা করতে যেতাম।
কলা ভবনের দক্ষিণ পাশের ভবনটি উপাচার্যের বাসভবন। আমাদের সময়ে তিনজন উপাচার্য ছিলেন যথাক্রমেঃ প্রফেসর আব্দুল মান্নান, প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া ও প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ। এ বাড়িতে প্রথম উপাচার্য হয়ে আসেন জোসেফ হার্টগ, ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে ১ জুলাই ১৯২১ সালে।
অতঃপর একদিন গেলাম কার্জন হল দেখতে। সামনে ছিল সুন্দর বাগান এবং ছিল ছোট ছোট গাছের সমাহার। বিপরীত দিকেই হাইকোর্ট ভবন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি স্মৃতিবিজডিত কলা ভবনের সামনের বটতলায় উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
এ দুঃখে নাকি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে এ বটগাছটিকে কেটে ফেলে হৃদয়ের ক্ষোভ মেটায়। পরবর্তী সময়ে বাহাত্তর সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি একটি বটের চারা একই স্থানে লাগিয়ে দেন, যা আজও সেই অতীতের বটগাছকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্মাণ করা আছে অনেক ভাস