(ছবি:মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের মানচিত্র)
সম্পাদনায়: মো:আতাউর রহমান সরকার
প্রকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি আমাদের এই মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প। মেঘনা ও ধনাগোদা নদীবেষ্টিত এই প্রকল্প হওয়ায় এর নামকরণ হয়েছে মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প।
মূলত, পদ্মা মেঘনার সংগম স্থলের পূর্ব পাড়ে মেঘনার বুকে এটি একটি জেগে উঠা চর।
প্রমত্তা মেঘনার পলল বিধৌত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শস্য শ্যামল প্রান্তর এই চর। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের মত ছোট বড় সোয়া তিনশটি গ্রাম রয়েছে এখানে।
ঢাকা হতে ৪০ কিঃমিঃ পূর্ব দক্ষিনে, চাঁদপুর হইতে ১৯ কিঃমিঃ উত্তরে মতলব উত্তর উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১৩ টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প।” এখানকার ৯০% জমি বছরের প্রায় ৬ মাস পানির নিচে নিমজ্জিত থাকত।
বর্তমানে এখানে এডিবি’র আর্থিক সহযোগীতায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরোধী বেড়ি বাধ নির্মান করা হয়েছে। আবহাওয়া, মাটি, পানি এবং মানব সম্পদ,যোগাযোগ এই ৫ টির সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহারের উপর নির্ভর করে আমাদের সমৃদ্ধি।
কৃষিপ্রধান এই দেশকে সমৃদ্ধির জন্য ১৯৬৪ সালে ৫৮ টি বন্যা প্রতিরোধ এবং নিষ্কাশন প্রকল্পের একটি সমন্বিত মাষ্টার প্লান গৃহীত হয়েছিল।
“মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প” এই প্রকল্পের মধ্য অন্যতম একটি। সর্বাধুনিক কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতাকে বাড়নোর লক্ষ্য ১৯৬৪ সালে মতলব থানার উত্তর অঞ্চলের নদী বেষ্টিত ১৪ টি ইউনিয়নে “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের” সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালায় পাকিস্তান টেকনো কনসালট্যান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর দেশ পূর্নঃগঠনে হাত দিলে এ প্রকল্পটির দাবী সামনে চলে আসে।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু নদী পথে স্টীমার যোগে ফরিদপুর যাওয়ার পথে ষাটনলে যাত্রা বিরতি কালে স্থানীয় রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ প্রকল্পের দাবীটি সামনে নিয়ে আসেন। তখন ষাটনলে একটি সারকারখানা নির্মাণের ও পরিকল্পনা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তনের কারণে বাস্তবায়িত হয় নি।
১৯৭৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চৌ-কায়হাটসু কর্পোরেশন(সিকেসি) এবং বংলাদেশের মেসার্স প্রকৌশলী সংসদ লিঃ যৌথ ভাবে এডিবি’র আর্থিক সহযোগীতায় “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের” সম্ভাব্যতা পুনরায় যাচাই করে সংশোধিত রিপোর্ট তৈরি করেন।
একই বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ যোগান দিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের সাথে প্রকল্পে অর্থ সহ যোগীতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৯-১৯৮০ সালে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে অরম্ভ হয়।
১৯৮৭-১৯৮৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। চিনের দুঃখ হুয়ংহু নদী আর “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প” বাসীর দুঃখ মেঘনা-ধনাগোদা নদী। নির্মান শেষে প্রথমিক পর্যায়ে পর পর দুই বার ১৯৮৭এবং১৯৮৮ সালে বন্যার সময় বেড়ি বাধ ভেংগে কৃষকের মাঠের ফসল, পুকুরের মাছ, গবদি পশু সব বন্যার জলে ভেসে যায়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য সংস্থার সম্বনিত প্রচেষ্টায় ১৯৯০ সালে বন্যানিয়ন্ত্রন বাধের কাজ সমাপ্ত হয়। দীর্ঘ ২২০ কিলোমিটার সেচ খাল ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নিষ্কাশন খাল নির্মান করা হয়। ১৭৫৮৪ হেক্টর এলাকাকে বন্যা মুক্ত ও জলাবদ্ধতা হইতে রক্ষা করে ১৩৬০২ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রধানের জন্য “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প” নির্মান করা হয় ।
প্রকল্প এলাকায় ২ টি শক্তিশালী পানি উত্তোলন কেন্দ্র একটি উদমদীতে যার উত্তোলন ক্ষমতা ৪৩.৩৫ কিউমেক অপরটি কালিপুর যার উত্তোলন ক্ষমতা ২৮.৯কিউমেক। পাম্প গুলি সেচে এবং নিষ্কাশন দ্বিবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রকল্প এলাকায় রয়েছ দুইটি বোস্টার পাম্প পানি উত্তোলন কেন্দ্র, একটি একলাস পুর উত্তোলন ক্ষমতা ২.২৬ কিউমেক অপরটি ডুবগী উত্তোলন ক্ষমতা ৩.৪ কিউমেক। “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প” নির্মান সমাপ্তির পর প্রকল্প এলাকায় কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হয়েছে আশানুরূপ। শুধু উন্নত কৃষি পন্য উৎপাদন নয়। সাথে নানা রকম কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয় হাট বাজার রাস্তাঘাট যান বাহন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জীবন যাত্রার মানের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জীবন জীবীকার অনেক পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক ভাবেও মানুষ উন্নতি লাভ করছে। পানি সেচ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকতার ফলে ভৌত পরিবেশ উন্নত হইয়াছে। ইতিমধ্যে ব্যক্তি গত উদ্যোগে ব্যাপক বনায়ন ও মৎস চাষ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অপরিকল্পিত বনায়ন ও নিষ্কাশন খাল দখল করে মৎস ঘের প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যহত হওয়ার পথে।
দীর্ঘদিন চারিদিকে নদীবেষ্টিত থাকার কারণে মতলব ফেরীঘাট ছাড়া যানবাহন নিয়ে প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করতে না পারলেও ইতিমধ্যে শ্রীরায়েরচর ও মতলব সেতু নির্মাণের ফলে যাতায়ত ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বীমা এনজিও ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ফলে ব্যাপক কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মতলবের দুই কৃতি সন্তানের নাম জরিয়ে থাকবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে। মরহুম প্রকৌশলী আয়েত আলী এবং মরহুম প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক।
বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অপরিকল্পিত বনায়ন, রাস্তাঘাট নির্মান যত্রতত্র বাড়ি ঘর তৈরীর ফলে প্রকল্প এলাকার অনেক ফসলি জমি নষ্ট করা হচ্ছে। প্রতি বৎসর পানি নিষ্কাশন খাল এবং সেচ খাল সংস্কারের অভাবে অনেক এলাকায় সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে জলবদ্ধতায় কৃষক নিঃস্ব হচ্ছে আবার পানি সংকটে ভুগছে অনাবৃষ্টিতে।
ফলে প্রকল্প বাসী পুরাপুরি প্রকল্প সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার “মেঘনা ধনাগোদা সেচ প্রকল্প” এলাকায় নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় না থাকায় মানুষ বিভিন্ন কাজে অনেক হয়রানীর শিকার হয়। কারণ নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয় চাঁদপুর মঠখোলা প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থান হওয়ায় সুবিধা ভোগীদের যোগাযোগ দুরত্ব সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকল্প বাসী। প্রকল্প এলাকার সেচ ও নিষ্কাশন নালা প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে।
প্রকল্প অঞ্চলে একটি ফেডারেশন ও ৩০ টি পানিব্যস্থাপনা দল রয়েছে সেচকার্যক্রম পরিচালনার জন্য।
প্রকল্প শুরু পর থেকে শুধু মাত্র বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধা প্রদান করলেও ইদানীং বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তন এর ফলে প্রকল্প এলাকায় আউশ ও আমন মৌসুমে জরুরী সেচ সুবিধা প্রদান এর জন্য দীর্ঘদিন যাবত কৃষকরা দাবি জানিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এর নেতৃত্বে প্রকল্প ঢেলেসাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। গত আমন মৌসুমে সাময়িক সেচসুবিধা প্রধান করেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক ইতিমধ্যেই প্রকল্প অঞ্চল পরিদর্শন করে গেছেন। প্রকল্প উন্নয়নে সুপারিশ করেছেন। এছাড়া অপরিকল্পিত বনায়ন বন্ধে সচেতনতা তৈরি, সারা বছর জরুরী সেচ সুবিধা প্রদান ও নিষ্কাশন খাল পূর্নখননের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিসার, উপজেলা সেচ কমিটি, মেঘনাধনোগোদা পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশন সহ “কৃষি উদ্যোক্তা পরিষদ মতলব উত্তর উপজেলা,চাঁদপুর ” সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।