দূষণ কমানোসহ জলবায়ুর উন্নতির পথ খোঁজার দাবি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ২০২৩ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। এই সতর্কবার্তার আলোকে পরিবেশের দূষণ কমানোসহ জলবায়ুর উন্নতির জন্য বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস। গত ৩০ নবেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের এক্সপ্রো সিটিতে জাতিসংঘের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এ উদ্বোধনীতে তিনি এমন আহ্বান জানান।
পরিবেশের দূষণ কমানোসহ জলবায়ুর উন্নতির জন্য বিশ্বনেতাদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, মারাত্মক তাপপ্রবাহ, বন্যা ও দাবানলের কারণে ২০২৩ সাল সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা আসলে জলবায়ু ধসের মধ্যদিয়ে বেঁচে আছি। জাতিসংঘ মহাসচিব যখন এমন আশংকার কথা বলছেন সেখানে বৈশ্বিক জলবায়ু দূষণের শিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বেশ কিছু দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরবে বাংলাদেশ।
কয়েক যুগের তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ, একের পর এক দাবানল, এশীয় অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা থেকে শুরু করে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডোর মতো ঘটনা করোনা মহামারির পরে জলবায়ু সংক্রান্ত আরেকটি মহামারির বার্তা দিচ্ছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন ধনকুবের বিল গেটস ও সচেতন অনেকেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে পুরো বিশ্বই এখন জর্জরিত। কার্বন নিঃসরণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা, উত্তরের বরফ গলাসহ বিভিন্ন দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বরফ গলে যাওয়ার কারণে ডুবে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ নানা দেশ। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমাধান খোঁজার অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে বসেছে জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলন কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ)-এর ২৮তম আসর।
যেখানে বিশ্ব নেতারা পরিবেশের দূষণ কমানোসহ জলবায়ুর উন্নতির পথ খুঁজবেন বলে আশা বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর। জলবায়ুর বিষয়ে একটি ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তের লক্ষ্যে পুরো বিশ্বের চোখ এখন কপ-২৮ সম্মেলনের দিকে। টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্মেলনের সভাপতি আয়োজক দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী সুলতান আহমেদ আল জাবের বলেন, এবারের সম্মেলনে প্রথমবারের মতো বিশ্বের বাঘা বাঘা তেল কোম্পানির মালিকদের দাওয়াত করা হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে প্রাইভেট খাতের বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও জানানো হয়েছে আমন্ত্রণ। এতে করে সবাই এক টেবিলে বসে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বিপাকে বিশ্ব অর্থনীতি। হ্রাস পেয়েছে বিশ্বের জিডিপি। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে কপ-২৮ জলবায়ু আলোচনা শুরুর দুই দিন আগে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী জিডিপির লোকসান ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ বা প্রায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের দেশগুলো তাদের জিডিপির যথাক্রমে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ২ শতাংশ হারিয়েছে।
আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো গত ৩০ বছরে মোট ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মূলধন এবং জিডিপির সম্মিলিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের মোট ২০২৩ জিডিপির প্রায় অর্ধেক।
সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশে অতিমাত্রায় গরম পড়েছে। বৃষ্টির সময় হচ্ছে না বৃষ্টি। আবার যখন হচ্ছে তখন অতিবৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে ফসল। বন্যা ও খরা দেখা দিচ্ছে। শীতের সময় পড়ছে না শীত। যখন পড়ছে তখন কাঁপন ধরা শীত পড়ছে। জলবায়ুর এমন অদ্ভুতুড়ে পরিবর্তনে হিমশিম খাচ্ছে দেশ। আর এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে কপ সম্মেলনে বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও চাওয়া নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, এবারের কপ-২৮ সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল কার্যকর ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। প্রতিনিধিদল সম্মেলনে বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আলোচনায় স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে অত্যন্ত বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসূহের পক্ষে অবস্থান নেবে। শাহাব উদ্দিন বলেন, এ সম্মেলনে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড অপারেশনালাইজ’ করা এবং এর ‘ডিটেইল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ ঠিক করা, অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য ‘গ্লোবাল গোল অন এডাপটেশন’র কাঠামো তৈরি, উন্নয়নশীল দেশসমূহে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় উন্নত দেশসমূহের ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান নিশ্চিত, জলবায়ু অর্থায়নের সংজ্ঞা চূড়ান্ত ও অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করাসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশ জোরালো ভূমিকা পালন করবে।
তিনি বলেন, কপ-২৮ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মতামত নিয়ে একটি অবস্থানপত্র প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ যার দ্রুত উন্নয়ন অত্যাবশ্যক এবং সেই লক্ষ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থায়ন ও প্রযুক্তির সরবরাহ প্রয়োজন।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা, জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান এবং মুজিব জলবায়ু ও সমৃদ্ধি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সহায়তা প্রয়োজন উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য বিদ্যমান যে বরাদ্দ রয়েছে, বাংলাদেশের তার থেকে অনেক বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এরইমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
এদিকে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) দেশের জলবায়ু পরিস্থিতি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দাবি উপস্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছে। ক্যাপস বলছে, বিশ্বের ধনী ও উন্নত দেশের প্রায় ১ ভাগ মানুষ যে পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে সেই পরিমাণ কার্বন নির্গমন করে বিশ্বের প্রায় ৬৬ ভাগ মানুষ। বাংলাদেশের কার্বন নির্গমনের পরিমাণ খুবই নগণ্য। তারপরও প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এবারের জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলের ইকোনমিক এবং নন ইকোনমিক উভয় দিক নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ইকোনমিক লসের সঙ্গে নন ইকোনমিক লস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, জলবায়ু সম্মেলন এমন একটি প্লাটফর্ম, যেখানে সমস্ত দেশই আসে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় একত্রিত হয় কাজ করার জন্য। জলবায়ু ন্যায্যতা আদায় ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে যুবকদের স্বীকৃতি ও বৈজ্ঞানিক গবেষণাভিত্তিক সমাধানকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্যাপসের লিগ্যাল ডিরেক্টর অ্যাডভোকেট রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হয়েও ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি যদি একটি জাহাজের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে এর নিচ তলায় আছে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ এবং উপরতলায় আছে উন্নত দেশগুলো, শেষ পর্যন্ত জাহাজডুবি অর্থাৎ ভয়াবহ দুর্যোগ হলে কেউ বাঁচতে পারবে না। তাই সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ নিয়ে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে।
ক্ষতিপূরণ আদায়ে জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৮) বাংলাদেশ জোরালো অবস্থান নিবে উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী দেশগুলো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কাঙ্খিত ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাই ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল কার্যকর ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। কম পরিমাণ কার্বন নির্গমন করেও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রায় ত্রিশটি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এর ভেতর উপকূল, বরেন্দ্র, চর, পাহাড়, বনভূমি, গড়, হাওর-জলাভূমি এবং নদী সমতল অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ ও বিপদ একইভাবে প্রভাব ফেলে না। প্রতিটি অঞ্চলে এবং প্রতিটি অঞ্চলের নানা পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন রকমের প্রভাব রয়েছে। তাই অঞ্চলভেদে বিভিন্ন এলাকার মানুষের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো আলাদাভাবে আলোচিত হতে হবে। তারা দুবাইয়ের জলবায়ু সম্মেলনের ২৮তম আসরে দেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের দাবি ও সুপারিশ আলোচনা করার প্রস্তাব রাখেন। যাতে করে বাংলাদেশের জনগণের জলবায়ু সংক্রান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিখ্যাত আমেরিকান সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইকে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেনের সঙ্গে একটি নিবন্ধে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ের জন্য আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদেরকে দায়িত্ব দিতে হবে এবং এই লড়াইয়ে তাদের অর্থায়ন করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রথম সারিতে থাকা মানুষকে রক্ষায় সাহায্য না করলে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু কার্যক্রমের কোনো মানে হয় না। আমাদের স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক উদ্যোগের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় তহবিল দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে হস্তান্তর করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নিবন্ধে তিনি আরও বলেছেন, কপ-২৮ তখনই সফল হবে যখন এটি জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কমিউনিটির জন্য প্রকৃত সুবিধা অর্জন করবে।