গ্রাম বাংলার আবহমানকাল থেকে চলে আসা অন্যতম একটি শৈল্পিক বিনোদনের মাধ্যম হলো যাত্রাপালা। যদিও কালের গহ্বরে তা আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। বর্তমানে যাত্রার নামে যা কিছু টিকে আছে সেখানে অশ্লীল কিছু নৃত্য, অর্ধ নগ্ন নারীর কোমর দোলানো, সুরসুরি দেওয়া অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্লীল সংগীত ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। একটা সময় এদেশের গ্রাম বাংলার মানুষের বিনোদনের প্রধান উৎস ছিল যাত্রাপালা। বিশেষ করে শীতকালে গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন করা হত। মানুষ কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে কাঁপতে কাঁপতে কম্বল মুড়ি দিয়ে সারারাত্র যাত্রাপালা উপভোগ করত। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই পারে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে। কখনো ঐতিহাসিক কল্পকাহিনী আবার কখনো সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। অভিনয়ের মাধ্যমে তাই সরাসরি তুলে ধরা হয় যাত্রাপালায়। এক সময় যার জনপ্রিয়তা ছিলো সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে। কিন্তু প্রাচীন এই সংস্কৃতি আজ প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। শিল্পিদের অভিযোগ, যাত্রাপালার নামে অশ্লীলতা ধ্বংস করে ফেলছে এই শিল্পকে।
তবে হাওর অঞ্চলের দিকে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ছিল ঢব যাত্রাপালা। কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসলেও সুনামগঞ্জের হাওর জনপদে এখনও মাঝেমধ্যে মঞ্চস্থ হয় এই যাত্রাপালা। রাতভর তা উপভোগ করেন সাধারণ মানুষ।আগের দিনে দুর্গাপূজার সময় ধুমধামের সাথে পৌরাণিক কাহিনী-নির্ভর এই যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। ঢব যাত্রাপালার বৈশিষ্ট্য হলো, এর জন্য কোনও উঁচু মঞ্চ তৈরি হয় না। দর্শক-শ্রোতা আর অভিনেতারা একই স্তরে থাকেন। ছেলেরা গোঁফ কামিয়ে মেয়ের অভিনয় করেন। আবার প্রয়োজনে কালি দিয়ে গোঁফ আঁকা হয়। কাহিনীর প্রয়োজনে ছেলে-মেয়েদের জন্য বাহারি সব চুল, ঝলমলে পোশাক, মুকুট আর তরবারির ব্যবহার হয়। মেকআপও নেন নিজেরাই।
যাত্রাপালা সাধারণত রাজা-রাজরাদের কাহিনী অথবা ঐতিহাসিক প্রণয় উপাখ্যানগুলো বেশি প্রাধান্য পায়।সে ক্ষেত্রে কাহিনী রচনা করার সময় রচয়িতাগন টার্গেট কাস্টমারের কথা মাথায় রাখেন। যাত্রাপালা যেহেতু গ্রামেগঞ্জে একেবারেই অশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত মানুষের বিনোদনের খোরাক তাই তাদের অভিরুচির সাথে মিল রেখে সহজ-সরল হৃদয়বিদারক কাহিনী কিংবা যুদ্ধের বীরত্বগাথা ইত্যাদি পটভূমি হিসেবে নেওয়া হতো। যাত্রার আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য- যেটা থিয়েটার থেকে তাকে আলাদা করে,সেটা হল ৩৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেল। মঞ্চনাটকে কিংবা থিয়েটারে দর্শকরা সাধারণত মঞ্চের সামনে বসে থাকে কিন্তু যাত্রামঞ্চ চতুর্দিকে খোলা থাকে এবং মঞ্চের চতুর্দিকে দর্শকরা গোল হয়ে বসে ফলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় যে তার সামনে, পেছনে, ডানে, বামে- সবদিকেই দর্শক রয়েছে তারা তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এর ফলে তাদের অভিনয় দক্ষতা আরো বেশি প্রয়োজন হয়। থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে দর্শক পর্যবেক্ষণ করায় তাদের ভুলভ্রান্তি করার সুযোগ কম থাকে। এটা যাত্রার একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া এই যাত্রা শিল্প নিয়ে নাট্যপরিচালক কায়সার আহমেদ বলেন, যাত্রা শিল্পটা আজ ধ্বংসের মুখে। এটাও তো একটা শিল্প। একটা সময় আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, যাত্রায় ছেলে মেয়ে সেজে অভিনয় করত। এখনকার ছেলে মেয়েরা এসব দেখে না। আমাদের এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই যাত্রা শিল্পের কথা মাথায় রেখেই আমি ‘বকুলপুর’ নামে একটি ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেছি যা বর্তমানে টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে। যাত্রার দিকে যাতে ধাবিত হয় মানুষ সেই কথা মাথায় রেখে নাটকের গল্পটা সাজিয়েছি। এখানে যাত্রা নানান দিক ফুটিয়ে তুলেছি । এই নাটকটি দেখলে এখনকার প্রজন্ম যাত্রা সম্পর্কে জানতে পারবে। আমাদের সবার স্ব স্ব জায়গা থেকে ঐতহ্যবাহি এই শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে তার সাথে সাথে অবশ্যই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও প্রয়োজন।
এক সময়ের খ্যাতমান যাত্রা শিল্পী নায়ক মৃণাল কান্তি বলেন, যাত্রা বিনোদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগ্রাম আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছে। যাত্রা লোক শিল্পের বাহন। যাত্রা যুগে যুগে মানুষকে সাম্যের বাণী শুনিয়েছে। বিভিন্ন সংগ্রামে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। অথচ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যাত্রা শিল্প আজ ধ্বংসের পথে। এই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পালাকার, গায়ক, অভিনয়শিল্পী, নৃত্য শিল্পী, দলনেতা, মালিক, পরিচালক, যন্ত্র শিল্পীসহ অসংখ্য মানুষের রোজগার। তিনি দুঃখ করে বলেন, যাত্রা শিল্পের পেশাগত কোনো নিশ্চয়তা নেই। কখনো যাত্রানুষ্ঠান হয় আবার কখনো বন্ধ হয়ে যায়। এর কোনো নীতিমালা নেই। সরকার যদি এর একটি নীতিমালা করতেন তাহলে যাত্রা শিল্পের পেশাগত সংকটের অবসান ঘটত। সরকার যদি যাত্রা শিল্পীদের প্রতি সদয় হতো তাহলে রক্ষা পেত বাংলার আদি কৃষ্টি যাত্রা শিল্প।
প্রাক্তন যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ জানান, শিশুকাল থেকে যাত্রাপালায় অভিনয় করছি। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে ৩ ছেলে মেয়ে মানুষ করেছি। ভালবেসে এখনো ধরে রেখেছি যাত্রাভিনয়। বর্তমানে তরুণরা আর যাত্রাভিনয়ে আসতে চায় না। তরুণরা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের উত্তরণ ঘটতো। এটি একটি ভাল মাধ্যম। এখানে শেখার অনেক কিছু রয়েছে।
যাত্রাশিল্পীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল যাত্রাশিল্পীদের জন্য সুদিন। তারপর থেকে আস্তে আস্তে এ শিল্পে অশ্লীলতা, জুয়া-হাউজি ঢুকে পড়ে। ডিশ এবং ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন সহজলভ্য হয়। অনেক যাত্রাপালার মালিক অধিক মুনাফার আশায় অশ্লীলতার দিকে ঝুঁকে পড়লে প্রশাসন থেকে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। দুঃখ প্রকাশ করে যাত্রাশিল্পীরা আরও বলেন, বর্তমান সময়ে যাত্রাপালার নামে তারা নারী দেহের অশ্লীল পসরা সাজিয়ে বিভিন্ন মেলাতে মানুষ থেকে- বিশেষ করে যুবক সমাজ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর মাঝে শিল্পের কোন চর্চা নেই। সেই ঐতিহ্যের কোন ছাপ নেই। এটা বর্তমানে কেবলমাত্র ব্যবসা।