চাকরি না পেয়ে অবশেষে কৃষিতে সফল আতাউর রহমান।
লেখাপড়া করে শুধুই চাকরির পেছনে ছুটতে হবে বা চাকরিই করতে হবে এরকম কোনো কথা নেই। লেখাপড়া শেষ করে নিজের মেধা আর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে চাইলে অন্যভাবে ও সফল হওয়া যায়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার সফল একজন কৃষি উদ্যোক্তা মো. আতাউর রহমান সরকার।
মো: আতাউর রহমান চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলা ছেংগারচর পৌরসভার ওটারচর গ্রামের মরহুম মো. খোরশেদ আলমের বড় পুত্র। তিনি নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজের সমাজকর্ম বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন, বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৩১। তিনি লেখাপড়া শেষ করে চাকুরির জন্য ঘোরাফেরা করেছেন, অবশেষে চাকরি না পেয়ে নিজের প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা।
জানা গেছে, পড়াশুনার শুরু থেকেই তিনি তার বাবার সাথে কৃষি কাজে সময় দিয়েছেন। ২০১৫ সালে বাবাকে হারিয়ে পরিবারের বড় ছেলে হয়ে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি হাল ধরতে হয় পরিবারের। তখন তিনি সরকারী তোলারাম কলেজ নারয়ণগঞ্জের অনার্স পড়ুয়া ছাত্র। বাবাকে হারিয়ে হাল ছাড়েননি তিনি। নিজের গ্রামেই বর্গা জমিতেই গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্ন রকম শাক-সবজির বাগান। তার বাগানে উল্লেখযোগ্য সবজি হচ্ছে আখ, শসা, মূলা,ফুলকপি,ধনিয়াপাতা, টমেটো,লালশাক,মরিচ।
সব্জির বাগান থেকে কলেজ ৫০-৬০ কিলোমিটার দূর ও নদী পথ থাকায় পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিলো না। তবুও তার উদ্যম সাহস থাকায় সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি একটি বাইসাইকেল ও লঞ্চ যাতায়াত এর উপর নির্ভর করে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে দীর্ঘ আট বছরে সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগ পেয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। এদিকে সব্জি বিক্রি করে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহের পাশাপাশি ফসলি জমিও ক্রয় করেন। ভাইদের পড়ালেখার খরচ ও বহন করেন।
জানা যায় , তার মেঝ ভাই রেজাউল করিম বর্তমানে ডুয়েট এর ছাত্র এবং ছোট ভাই মিরপুর বাংলা কলেজ এর ছাত্র।
কৃষিতে সাফল্যের অবদানের জন্য তিনি জেলা পর্যায়ে “শ্রেষ্ঠ কৃষক পুরস্কার ২০২২” অর্জন করেন। এছাড়া “কৃষি জগৎ সম্মাননা স্মারক ২০২০” অর্জন করেন তিনি।
এ বছর ১৫০ শতক জমিতে চাষ করেছেন মরিচ,শসা, মূলা,টমেটো, ধনিয়াপাতা,ফুলকপি লালশাক । এবার তার জমিতে মূলার বাম্পার ফলন হয়েছে। ৪০ শতকে পাইকারী মূল্যে বিক্রি করেছেন এক লক্ষ টাকা। মরিচ বিক্রি করেন ৫০ হাজার টাকা, লালশাক বিক্রি করেন ৫০ হাজার টাকা। ধনিয়াপাতা বিক্রি করেছেন একলক্ষ টাকা। ফুলকপির বাম্পার ফলন হয়েছে সবকিছু ঠিক ঠাক থাকলে এবার কপি বিক্রি আসতে পারে ১.৫ লাখ টাকা। টমেটোর জমির লক্ষণ ও ভালো ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলে বিক্রি হবে একলক্ষ টাকা। এছাড়া আমান ধান ও বাম্পার ফলন হয়েছে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে ৫০হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি। এছাড়া এক একর ভুট্টা আবাদ করবেন। ইতিমধ্যে কিছু জমিতে বপন করেছেন। চাষ করবেন দেড় একর জমিতে বোরোধান।
জানা যায়, তিনি আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফলো করার কারণে ফসল উৎপাদনে খরচ হয় কম। ২০% খরচ করলে লাভ গুনেন ৮০%। প্রাকৃতিক পরিবেশে সম্পুর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে তিনি চাষ করেন। তার জমিতে কোনোরকম কীটনাশক ব্যবহার করা হয়না, ফলে একদম দেশীয় স্বাদে ক্রেতারা সব্জি কিনে খেতে পারবেন। আতাউর রহমান এর জমিতে ৪-৫ জন শ্রমিক কাজ করে। তার কৃষি কাজে তাকে সহায়তা করে আসছেন তার মা ও ভাই ।
মো: আতাউর রহমান এর কৃষি ফার্মে কর্মরত শাহলম বলেন দৈনিক ৪শ টাকা মজুরিতে কাজ করেন এখানে। এই টাকা দিয়েই সংসার চালান তিনি।
সৌদিআরব ১৮ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে আসেন একই গ্রামের ইদ্রিস মিয়া।
দেশে এসে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। গরুর ফার্ম দিয়ে লোকসান হল অনেক টাকা। আতাউর রহমান এর বিভিন্ন সবজির চাষ দেখে উৎসাহ পেলেন। নিজেও করলেন বিভিন্ন রকম সবজির চাষ। এতে করে এখন ইদ্রিছ মিয়া ও ভালো টাকা আয় করছেন।
আতাউর রহমান এর মা পারভীন বেগম বলেন, ২০১৫ সালে স্বামী হারানোর পর তখন খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। পরে ছেলে যখন পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষি কাজে মনোনিবেশ করলেন তখন তিনিও সহযোগীতা করতে লাগলেন। এখন আর কোনো চিন্তা নাই তার। ছেলে এখন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। ছেলের চাষ করা নানা রকমের সবজি বিক্রি করে অনেক টাকা আয় হয় তাদের।
এ বিষয়ে আতাউর রহমান সরকার বলেন, নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কৃষির পাশাপাশি পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরির পিছনে ছুটেছি। কিন্তু চাকরি জুটলোনা ভাগ্যে। পরে নিজের ক্রয় করা ও লিজ নেওয়া জমি গুলোতে আগের মতো সম্পূর্ণ অর্গানিক প্রদ্ধতিতে সবজির চাষ করি।
যে কারণে উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। আর বাজারে ভালো দামে বিক্রি করতে পারি। মূলা শসা আর মরিচ চাষ করার পরে এবার ফুলকপি ও টমেটোর চাষ করেছি। চাষে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা মতো। আল্লাহর রহমতে বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করছি ২.৫ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারবো। পড়াশুনার পিছনে না ঘুরে কৃষি কাজ করলে এতোদিনে অনেক টাকা আয় করতে পারতাম।
আমাকে দেখে আমাদের গ্রাম ও উপজেলার অনেকেই এখন বিভিন্ন রকমের সবজি চাষ শুরু করেছেন। একই সাথে আমার ফার্মে কাজ করে ৪ থেকে ৫টি পরিবারের কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি সহযোগীতা পেলে তিনি আরও জমিতে নানান ধরনের সবজি চাষের উদ্যোগ নিবেন।
এছাড়া জানা যায়, তিনি নিজের পাশাপাশি উপজেলার কৃষি উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন, কৃষি উদ্যোক্তাদের একত্র করার জন্য কৃষি উদ্যোক্তা পরিষদ মতলব উত্তর উপজেলা নামে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করেছেন। মেসেঞ্জারে সর্বক্ষণিক কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো কারো মাঠে গিয়েও পরামর্শ দিচ্ছেন। কৃষক-কৃষি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সমস্যাগুলো তুলে ধরছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট। কৃষি উপকরণগুলো যেমন: সেচ, সার, বীজ সরবরাহ ঠিক রাখতে উপজেলা কৃষি অফিসার এর সাথে একযুগে কাজ করছেন। আগাম আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছেন। এতে করে উপজেলার কৃষকরা উপকৃত হচ্ছে।
এ বিষয়ে মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফয়সাল মোহাম্মদ আলী বলেন, উচ্চ শিক্ষিত মো: আতাউর রহমান সরকার এখন অনেকেরই অনুপ্রেরণা। চাকরি পেতে ব্যর্থ হলেও তিনি কৃষিতে সফল। তার মতো শিক্ষিত বেকার যুবকরা যদি কৃষি কাজে এগিয়ে আসেন তাহলে দেশে কৃষিতে বিপ্লব হবে।
আমি অনেকেই উৎসাহ দেই কৃষি কাজ করার জন্য। সাথে সব ধরনের সহযোগিতা। যে কেউ পরার্মশ চাইলে আমি সহযোগিতা করি। আাতাউর রহমান এর সরকারি সহয়তার বিষয়ে তিনি বলেন,ইতিমধ্যে কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। উনি চাইলে আমি অব্যশই আরো সহযোগিতা করবো।