চন্দ্রানী চন্দ্রাঃ
পাহাড়, ঝর্ণা প্রকৃতি ঘেরা সিলেট। যতদূর চোখ যাবে পাহাড় টানবে। সেই সাথে প্রশান্তি মনে প্রাণে। ২০২৫ এ মে মাসের শুরুতে ঘুরতে গেলাম সিলেটে। যেখানে লন্ডনীদের বাস। যারা সিলেটি ছাড়া শুদ্ধ বাংলা কম বলতে পারে, এর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সিলেটের একটি রিলস ভাইরাল । আমি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারিনা, সিলেটি মাততাম পারি।
দিন দু’য়েক ছিলাম মেঘ, পাহাড় আর চায়ের দেশে,
সিলেট—যেখানে প্রকৃতি নিজেই কবিতা লেখে।
মে মাসের এক সকালে,
জয়ন্তিকার জানালায় চোখ রেখে পথের গল্প বুনতে বসলাম।
ইটের শহর পেছনে, সুরের মতো ট্রেন ছুটে চলে,
সবুজের মায়ায় ঘেরা পাহাড়ি আলিঙ্গনে।
স্টেশনে থেমে, কুলাউড়ার কোলে বিশ্রাম,
মার্কেটের গা ঘেঁষা হোটেল, শান্ত এক বিশ্রামের নাম।
সন্ধ্যায় রাস্তায় ফুচকা-চটপটির গন্ধ,
চেনা মুখ, দূরের প্রবাসী ভাইয়ের হাসি-আন্দোলিত সন্ধ্যা।
ভাবীর হাতের রান্না, আড্ডার আলতো জোয়ারে,
রাত গড়িয়ে গেল গল্পের স্রোতে, চায়ের তপ্ত ঘ্রাণে।
নিশ্ছিদ্র প্রকৃতির কোলে,
চা-বাগানের সবুজ গালিচা মাড়িয়ে কুলাউড়া থেকে পথচলা শুরু—
যেখানে হাওরের বুক জুড়ে মেলে ধরে সৌন্দর্যের হাতছানি
হাকালুকি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি,
বাংলাদেশের হৃদয়ে সে এক বিস্ময়ের নাম।
জুড়ী উপজেলার পথে প্রান্তর পেরিয়ে
বড়লেখার বুকে উঁকি দেয় এক স্বপ্নিল ধারা—
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ, সবচেয়ে অপরূপ জলপ্রপাত
‘মাধবকুন্ড’, যেন পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে
অতল থেকে নেমে আসা প্রকৃতির কাব্য।
৩২ কিলোমিটার দূরে কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে
কাঁঠালতলীর আঁকাবাঁকা পথে গিয়ে দেখা মেলে তার,
২০০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে পড়া সেই ঝর্না
শুধু জল নয়, যেন সাহস, সৌন্দর্য আর শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
তারই পাশে, নিরবে গড়ে উঠেছে ‘খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর’ আবাস।
চতুর্দিকে বিস্তৃত সবুজ বনভূমি আর
‘মাধবকুন্ড ইকোপার্ক’, যেখানে প্রতিবছর ছুটে আসে লাখো পর্যটক।
ধর্ম আর সংস্কৃতিরও মিলনস্থল এটি—
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ‘বারুনী স্নান’ হয় এখানে
চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে,
চারদিকে বসে মেলা, গানে, আলোয় আর ভক্তিতে।
এ যেন শুধুই ভ্রমণ নয়—
প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের ছোঁয়ায় গড়া এক ‘জীবন্ত উপাখ্যান’।
সবুজের সমারোহে, প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বানে,
কুলাউড়া থেকে কমলগঞ্জের পথে,
চা-বাগানের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে,
পৌঁছে যাই লাউয়াছড়ার বুকে।
এখানে, প্রকৃতি তার সৌন্দর্য্যের ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে,
বিচিত্র গাছপালা, হরিণের লাফ, বানরের কোলাহল,
সাপের নিঃশব্দ গতি, বনমোরগের ডাক, মেছো বাঘের ছায়া—
সব মিলিয়ে এক জীবন্ত জাদুঘর।
এই বনের বুক চিরে চলে গেছে রেলপথ,
যেখানে ‘Around the World in 80 Days’ সিনেমার দৃশ্য ধারণ হয়েছিল,
ট্রেন থেমে যায়, হাতির মিছিলের সামনে,
ডেভিড নিভেন নেমে এসে দেখেন সতীদাহের প্রস্তুতি,
নায়ক ছুটে গিয়ে বাঁচান শার্লি ম্যাক্লেইনকে—
এই দৃশ্যগুলোই ধারণ হয়েছিল লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়।
হুমায়ুন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমার শুটিংও হয়েছিল এখানে,
প্রকৃতির মাঝে শিল্পের সংমিশ্রণ।
এখানে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত আফ্রিকান টিক গাছ,
উল্লুকের কোলাহল, বনরুই, অজগর, পাখির মেলা—
প্রায় ২৭৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
উদ্যানের ভিতরে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাসিয়াপুঞ্জি,
যারা ধারণ করে আছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
লাউয়াছড়ায় রয়েছে এক, দেড় ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল,
যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারে,
তিন ঘণ্টার হাটার পথ বেশ রোমাঞ্চকর
এ যেন শুধু একটি বন নয়,
প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক অপূর্ব মিলনস্থল।
লাউয়াছড়ার সবুজ বুকে শ্বাস নিয়ে,
আমরা পা রাখি শ্রীমঙ্গলের চা-ভাসা রাজ্যে।
চা-পাতার ঘ্রাণে ভরে যায় প্রাণ,
সাত রঙের চায়ে মেলে ধরে মোহের সন্ধান।
শীতল কাপ উষ্ণ চা হাতে, প্রশান্তির ঢেউয়ে ভাসি,
প্রকৃতি যেন কবিতা হয়ে মিশে যায় নিঃশ্বাসে।
হাকালুকি হাওরের বিস্তৃত জলরাশির পরশ,
চা-বাগানের সবুজে হৃদয় হোক মসৃণ স্পর্শ।
পাহাড় ছুঁয়ে আমরা পৌঁছি শমসেরনগর স্টেশনে,
ট্রেন ধরার আশায় দাঁড়িয়ে থাকি প্রতীক্ষার রেখায়।
কিন্তু মাধবকুন্ড, বড়লেখা, লাউয়াছড়ার প্রেমে,
৫.৩০-এর ট্রেন আমাদের ছেড়ে যায় চুপিচুপি।
রাত ১০.৩০-এ টিটিকে ম্যানেজ করে
আমরা পৌঁছাই সিলেট শহরের গহীনে, রাত সাড়ে এগারোটায়।
আগে থেকেই বুক করা গ্লোডেন সিটি হোটেল,
শান্তির রাত, ঘোরার প্ল্যানে ভরা সকাল।
১৫০০ টাকায় সিএনজি মেলে,
রওনা দেই রাতারগুল আর সাদা পাথরের টানে।
চা-বাগানের মাঝে বিখ্যাত ‘পাঁচ ভাইয়ের হোটেল’-এ,
বেগুন ভাজা আর দশ রকমের ভর্তায় খুঁজে পাই অমৃতের স্বাদ।
সকালের রৌদ্র হাসে, সিএনজি এসে হাজির,
আমরা ছুটে চলি বাংলার অ্যামাজন রাতারগুলের দিকে।
গোয়াইনঘাটের ফতেহপুরে বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে,
জলরাশি ঘেরা এক জলার বন, ৮০% গাছে ভরা,
যেন প্রকৃতির গোপন আয়োজন।
ডিঙি নৌকা ভাড়া নিয়ে বনে প্রবেশ,
মাঝির গানে ছবি-ভিডিওতে বন্দী করি সময়।
মেঘালয়ের জলধারা এসে নামে গোয়াইন নদীতে,
সেখান থেকে চেঙ্গী খাল হয়ে প্লাবিত করে রাতারগুল বন।
মে থেকে সেপ্টেম্বর জলে ভরা, শীতে শুকনো,
পাতা ঝরে, বন রূপ নেয় নিস্তব্ধ মঠোপথে।
ডোবার জলেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণের পরিবার,
রাতারগুল—এক স্বপ্নলোক, সিলেটের বুকের হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য।
সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর অঞ্চল, ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত, প্রকৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। এখানে স্বচ্ছ নীল জলে সাদা পাথরের বিছানা, মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণা, আর সবুজ পাহাড়ের সমাহার একত্রে এক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সাদা পাথরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে প্রথমে সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি বা বাসে করে ভোলাগঞ্জ বাজারে যেতে হয়। সেখান থেকে নৌকায় করে ধলাই নদী পাড়ি দিয়ে মূল সাদা পাথর এলাকায় পৌঁছানো যায়। বর্ষাকালে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নৌকা ভ্রমণ আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে, তবে হাঁটার পথ তখন অপ্রতুল হয়ে যায়।
এই অঞ্চলে স্থানীয় লোকজন পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে, যা সিলেটের পাথর শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে পর্যটকদের উচিত পরিবেশ রক্ষায় সচেতন থাকা এবং স্থানীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলা।
সাদা পাথরের এই মনোরম পরিবেশ প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক আদর্শ গন্তব্য। এখানে এসে আপনি স্বচ্ছ জল, সাদা পাথর, সবুজ পাহাড়, আর শান্ত পরিবেশের মুগ্ধতা উপভোগ করতে পারবেন।
এ যেন শুধু একটি সফর নয়,
প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের ভালোবাসায় গাঁথা
একটি কবিতা, একটুখানি জীবন।
বিদায়ের সুর বাজে ধীরে,
স্মৃতির খামে বাঁধা পড়ে পাহাড়, ঝর্ণা আর মানুষের হাসিমুখ।
কমলালেবুর দেশে কাটানো দুই দিন—
হৃদয়ে গেঁথে থাকে, অনন্ত ছুটির এক মনোজাগানিয়া মুহূর্ত।