ঠাকুরগাঁওয়ে অনলাইন প্রেমের ফাঁদ : ২৫ লাখ টাকা নিয়েও মিলনের প্রাণ রক্ষা হলো না
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি \ ঠাকুরগাঁওয়ে অনলাইন প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের পর ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়েও শেষ রক্ষা হলো না পলিটেকনিক শিক্ষার্থী মিলন হোসেনের (২৩)। বুধবার রাতে পুলিশ মূল অপহরণকারী সেজান আলীসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিলনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিলন হোসেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার খনগাঁও ইউনিয়নের চাপাপাড়া এলাকার পাঞ্জাব আলীর ছেলে। তিনি দিনাজপুর পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র ছিলেন।
এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার মহেশপুর গ্রামের মতিউর রহমানের ছেলে সেজান আলী (২৫), একই উপজেলার আরাজি পাইকপাড়া গ্রামের মুরাদ ওরফে নাসিম (২৫) ও ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের তেলিপাড়া মহল্লার রতœা আক্তার ইভা (১৯)।
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ‘শেষ বিকেলের গল্প’ নামে একটি ভুয়া নারী ফেসবুক আইডি খুলে মিলনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলত হত্যাকারীরা। একপর্যায়ে মিলনের সঙ্গে ওই নারীর দেখা করার তারিখ নির্ধারণ হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টায় ঠাকুরগাঁও পলিটেকনিকের পেছনে লিচুবাগানের ভেতরে প্রেমিকার (ইভা) সঙ্গে দেখা করতে যান মিলন। এ সময় পেছন দিক থেকে সেজান আলী ও মুরাদ তাকে ঝাপটে ধরে। পরে মিলন চিৎকার করলে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে তারা। এরপর মিলনের লাশ সেজানের বাড়িতে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ির পরিত্যক্ত সেফটি ট্যাংকে ফেলে মাটি চাপা দেয়।
ঘটনাটি তদন্তে নেমে ডিবি পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেজান ও মুরাদকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেজানের বাড়ির পাশের একটি অব্যবহৃত টয়লেটের স্লাবের নিচ থেকে মিলনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত রতœা আক্তার ইভাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, আসামি মুরাদের হেফাজত থেকে ৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে হত্যার কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও জব্দ করা হয়।
এর আগে গত ৫ মার্চ নিখোঁজ ছেলের সন্ধান চেয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মিলনের বাবা পাঞ্জাব আলী। এরপরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে গত বুধবার রাতে অপহরণ, আত্মসাৎ ও ভয়ভীতির অভিযোগ এনে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। পরে পুলিশ ডিবিতে মামলাটি হস্তান্তর করেন।
মিলনের বাবা পাঞ্জাব আলী জানান, ঘটনার দিন রাত ১টার সময় মিলনের মুঠোফোনে অপহরণের বিষয়টি জানায় অপহরণকারীরা। এ সময় তারা ছেলের মুক্তিপণ হিসেবে প্রথমে ১০ লাখ ও পরে ৩০ লাখ টাকা দাবি করে। সর্বশেষ মিলনের পরিবারকে ৯ মার্চ রাতে ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকাগামী রাত ৯টা ৩০ মিনিটের ট্রেনে উঠতে বলে অপহরণকারীরা। এরপর জেলার পীরগঞ্জের সেনুয়া এলাকায় চলন্ত ট্রেন থেকে ২৫ লাখ টাকার ব্যাগটি বাইরে ফেলে দিতে বলে চক্রটি। মিলনের জন্য দুই সেট পোশাকসহ ২৫ লাখ টাকা ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ১০ মিনিট পর টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে অপহরণকারী চক্র। এরপর দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে অপহৃত মিলনকে পাওয়া যাবে বলে তথ্য দেয় চক্রটি। কিন্তু স্টেশনে গিয়ে সম্পূর্ণ স্টেশন তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি করা হয়। সেই রাত ১১টা থেকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও ছেলের দেখা পায়নি পরিবারটি।
মিলনের পরিবারের সদস্যরা জানান, মিলনকে অনলাইনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ করা হয়েছিল। অপহরণকারীরা ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। টাকা দেওয়ার পরও মিলনকে জীবিত ফেরত পাওয়া যায়নি।
এদিকে, বৃহস্পতিবার মিলন হত্যাকান্ডের পর খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা প্রশাসকের চত্বরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে তার পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। শহরের চে ৗরাস্তায় ঘন্টাব্যাপী বিক্ষোভ করে পথরোধ করে রাখে এলাকাবাসী। পরে জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা ও পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম পিপিএম সুষ্ঠু তদন্ত করে হত্যাকারীদের বিচারের আশ্বাস দিলে এলাকাবাসী বাড়ি ফিরেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ পরিদর্শক নবিউল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃতরা সংঘবদ্ধ একটি অপরাধ চক্র। তারা এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়েছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়। হত্যার ঘটনায় তদন্ত চলছে।
মিলন হত্যা ঘটনা প্রকাশ পেলে সেটি ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় ঠাকুরগাঁওয়ে।