চৈত্রমাস হলো আবাহমান বঙ্গ সাংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বাংলা মাসের এই শেষ মাসটিজুড়ে নানান উৎসব পালিত হয়।মূলত মাসটি শিবের মাস।নানান ভাবে শিবের আরোধনা হয় এই সময়।
প্রচালিত লোককথা বলে,২৭টি নক্ষত্রের নামে দক্ষরাজ তাঁর ২৭ জন মেয়ের নামকরণ করেছিলেন।দক্ষরাজের এক মেয়ের নাম ছিল চিত্রা এবং অন্য এক মেয়ের নামছিল বিশাখা। বলাহয় চিত্রা নামটি নাকি দক্ষরাজ তিক্রা নক্ষত্র থেকে নিয়েছিলেন।পরবর্তী সময়ে দক্ষরাজের কণ্যা চিত্রার নাম থেকে জন্ম হয় চৈত্র মাসের।এই মাসের কথা বললেই মনে পড়ে সন্ন্যাসের কথা। ব্যস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে অনেকেই এক মাসের সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন। শিবের নামেই সন্ন্যাস নেওয়া হয়। পয়লা চৈত্র থেকে সংক্রান্তি অবধি। সারা চৈত্রমাস জুড়েই শোনা যায়, ‘বাবার চরণে সেবা লাগে মহাদেব’৷ আদপে একটি বাক্যটি বলে তারা মাধুকরী করতেন। পরনে সাধারণ ধুতি এবং গেঞ্জি, হাতে একটা থালা, কাঁধে ঝোলা৷ সন্ন্যাসীদের মতোই বেশ৷ কখনও কখনও একা আবার কেউ কেউ আট-দশ জনের দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষে করতে আসেন৷ সঙ্গে থাকত ঢাকির দল৷ জোরে জোরে ঢাকের শব্দ শুনে গৃহস্থের বাড়ি থেকে মহিলারা থালায় করে চাল, আলু, পয়সা সব ঢেলে দিতেন ওই সন্ন্যাসীদের থালায় বা ঝোলায়৷ এরাই চড়কের সন্ন্যাসী৷ সারা চৈত্র মাস জুড়ে তাঁরা বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে নিজেদের খাবারের সামগ্রী জোগাড় করেন, তারপর তা ফুটিয়ে খান, নিরামিষ আহার। শিবের পুজো করেন আর গাজনে অংশ নেন৷ এই সময় বাঁকে করে জল নিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালার রেওয়াজও রয়েছে। শিব-গৌরীর নাচ, বহুরূপী: গোটা বাংলা এখন বহুরূপীদের সঙ্গে পরিচিত। নানা রকম সেজেই তাঁদের উপার্জন। যদিও আজ তাঁরা বিলুপ্তির পথে। কিন্তু এখনও গ্রামে গঞ্জে তাঁদের দেখা মেলে, এই চৈত্রর সময়টাতেই। পাড়ায় পাড়ায় বের হয় শিব-দুর্গা বা শিব-গৌরী। বোলানের দল সেই পালা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পরিবেশিত করে। পালার প্রথমে থাকে শিবের বন্দনা ও শেষে পালাকর্তার নাম। বোলান গান মূলত চার প্রকার, দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান আর শ্মশান বোলান।
কথায় বলে, চৈত্রর ঢাকের শব্দে উড়ে যায়, শিমুলের ষোড়শী তুলো। তাই সংক্রান্তির আগেই শিমুল গাছের তুলো পেড়ে ফেলার রেওয়াজ রয়েছে। চৈত্রে শিবের মন্দিরকে ঘিরেই চলে উৎসব। শিবকে বুড়ো ঠাকুরও বলা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দশ বারোদিন আগে থেকেই শুরু হয় উৎসবের পর্ব। চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে শুরু হয় নানান অনুষ্ঠান ও লোকাচার। এসবের মধ্যে রয়েছে অষ্টক গান, গিরিসন্ন্যাস , বাসুর মরন, পাট চালান, পাটপূজা, খেজুর ভাঙ্গা, পূন্যস্নান। মেলা বসে। বারুণী ব্রত পালন করেন অনেকে। আম বারুণী অর্থাৎ দেবতার উদ্দেশ্যে আম নিবেদন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির আরেকটি উৎসব হল পাট পুজো। পাটই শিব। চড়কের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল পাট নাচানি। পাট সামনে রেখে বালারা নানা রকম খেলা দেখান, শারিরীক কসরত করেন একে অনেক জায়গায় ‘পাট নাচানি’ বলে। চড়ক দেবের প্রতিকৃতির নাম পাট। কাঠের পাটের মধ্যে থাকে শিবলিঙ্গ। রাতে গুরু সন্যাসী সেটি নদীতে নিয়ে যান।
এ সময় আয়োজকরা সং সেজে অর্থাৎ ভুত-প্রেত, দৈত্য-দানবের মুখোশ পড়ে সন্যাসীকে বাধা দেয়। সন্যাসী তান্ত্রিক ক্ষতায় সব বাধা উপেক্ষা করে পাট চালান করিয়ে তেল-সিঁদুর-চন্দন মেখে দেন। রাতে পাটকে স্নানের পর অজস্র পুজারীদের সামনে পাটকে মাঝখানে রাখা হয় তার পরে নাচ গানের মধ্য দিয়ে বালারা ধুপ পোড়ায় ও পাটকে লাল শালু দিয়ে মুড়িয়ে নেয়। এসময় সমস্বরে জয় বাবা শিব শংকর, এইবার উদ্ধার করো বলে চিৎকার করা হয়। সজ্জিত কাঠ দেবতা হয়ে ওঠে। তাতে লাল শালু মুড়িয়ে দেওয়া হয়। সিঁদুরে মাখানো হয় মাথার দিকটা। তারপর একজন সুঠাম দেহী পাট চালানে নেয় এবং ঘোরাতে ঘোরাতে মাথায় তুলে ছুট দেয়। মন্দিরের কাছে গিয়েই সে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে যায়। মাথায় জল দিয়ে তাকে সুস্থ করা হয়। পর দিন পাট নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরা হয়। সাথে বাজে ঢাক, কাসি-বাঁশি। এই পাট একজন মাথায় নেয়। এই পাটের সামনে কোন গর্ভবতী মহিলা পড়লে তার বিপদের আশঙ্কা থাকে বলে মনে করা হয়। পুজো ভিত্তি হল ভুতপ্রেত এবং পুনর্জন্মবাদ। গিরি সন্ন্যাসের দিনে সন্ন্যাসীরা নেচে নেচে গেয়ে বেড়ায়, আমরা শিবের নামে আছি, শিবের নামে বাঁচি। গোঁসাই শিবের নামে আছি, বাঁচি রে। পাট বাড়ি বাড়ি গেলে খেজুর ভাঙা উৎসব হয়। একজন বালা খেজুরের কাঁটা উপেক্ষা করে খেজুর গাছের একেবারে মাথা উঠে যায়। খেজুর ছুঁড়ে দেয় সবার দিকে। ওই খেজুর ঘরের দুয়ারে বেঁধে রাখেন অনেকে, বিশ্বাস করা হয় এতে আপদ বিপদ দূর হয়।