ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে শুক্রবার ৩০শে জুন আদিবাসী কল্যাণ পরিষদের আয়োজনে বিকেল ৪ টায় ১৬৮ তম সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উপলক্ষে র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত র্যালী বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদ চত্বোর হতে বের হয়ে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে পৌঁছে সমাপ্ত হয়।পরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদের সভা কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত সভায় বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আদিবাসী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি গোবিন্দ মার্ডির সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নিবাহী অফিসার বিপুল কুমার,বিশেষ অতিথি হিসেব বক্তব্য রাখেন-জেলা আদিবাসী কল্যাণ পরিষদের উপদেষ্টা এটিএম সামশুজ্জোহা,সংগঠনের সাধারন সম্পাদক মানিক মরমূ,নির্বাহী সদস্য দানিয়েল সরেন, প্রমুখ।
জানাযায়,৩০ জুন শুক্রবার ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রামের এক সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সে দিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম,আদর্শ ও আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল।সেইসাথে সাহস ও উদ্দীপনা জুগিয়েছিল মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই—সিধু মুরমু ও কানু মুরমু স্মরণে ও শ্রদ্ধায় সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে বলে থাকেন সিধু-কানু দিবস।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় দালাল সামন্ত জমিদার,সুদখোর,তাদের লাঠিয়াল বাহিনী, দারোগা-পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতাল নেতা সিধু,কানু,চাঁদ ও ভৈরব এই ৪ ভাইয়ের নেতৃত্বে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক রুখে দাঁড়ায়। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই বোন ফুলোমনি মুরমু ও ঝালোমনি মুরমুও।ভারতের ভাগলপুর,মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার প্রায় ১,৫০০ বর্গমাইল এলাকা দামিন-ই-কোহ্ বা “পাহাড়ের ওড়না”এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।ভাগলপুরের ভগনা ডিহি গ্রামের সিধু,কানু,চাঁদ ও ভৈরব ৪ ভাইয়ের নেতৃত্বে দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চলে সংঘটিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ।১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভগনা ডিহি গ্রামে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধিত্বে জমায়েত হয় ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষকেরা এই জমায়েতে সিধু-কানু ভাষণ দেন এবং এ সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে অত্যাচারী শোষকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাইকে একত্রিত হয়ে লড়তে হবে।এখন থেকে কেউ জমির কোনো খাজনা দেবেন না এবং প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা থাকবে যত খুশি জমি চাষ করবে এখন থেকে সাঁওতালদের সব ঋণ বাতিল হবে।তাঁরা মুলুক দখল করে নিজেদের সরকার কায়েম করার সিদ্ধান্ত নেন।
১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক সেদিন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করেছিলেন।ভগনা ডিহি গ্রামের ওই সভার শপথ ছিল বিদ্রোহের শপথ।বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল “জমি চাই,মুক্তি চাই”।জমিদার,মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও জুলুম থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির সঙ্গে উৎপাদনের কাজ ও জীবন ধারণ করার সংকল্প নিয়ে সাঁওতাল কৃষকেরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ান। তাঁদের এ বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দেন এলাকার শোষিত, অধিকার বঞ্চিত বাঙালি ও বিহারি হিন্দু-মুসলমান গরিব কৃষক এবং কারিগররা।সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সব সম্প্রদায়ের গরিব জনসাধারণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিবছরের এই দিনে সিধু-কানুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি,শোভাযাত্রা,আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ও বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ ও দেশের বিভিন্ন প্রগতীশীল সংগঠন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানুসহ সব আত্মদানকারীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এদিনটিতে উদযাপন করে থাকে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।এবারও বিদ্রোহের ১৬৮তম বার্ষিকীতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ,আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদ, আদিবাসী নারী পরিষদ, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম,আদিবাসী মুক্তি মোর্চা, নাচোল আদিবাসী একাডেমি,আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আদিবাসী কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে ১৬৮ তম সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস পালন করেন।
এ ছাড়া সাঁওতাল গানের দল সেঙ্গেল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিদ্রোহ দিবসের ওপর আলোচনা ও গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এতে অংশ নেয় স্থানীয় সাঁওতাল সাংস্কৃতিক নেতারা।সাধারণ নিরক্ষর ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার মানুষেরা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস না জানলেও বংশপরম্পরায় তাঁদের কাছে গানে গানে বেঁচে আছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে তাঁদের আজও গাইতে শোনা যায়,”সিদো-কানহু খুড়খুড়ি ভিতরে চাঁদ-ভায়রো ঘোড়া উপরে দেখ সে রে!চাঁদরে! ভায়রো রে!খোড়া ভাইয়োরে মুলিনে মুলিনে”।
পালকিতে সিধু-কানু এবং ঘোড়ায় চড়ে চাঁদ-ভৈরব বিদ্রোহীদের পাশে থেকে তাঁদের উৎসাহ দিতেন।নেতাদের কাছে পেয়ে বিদ্রোহীদের মনে যে আনন্দ ও আশার আলো দেখা যেত, এই গানের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।