রাজশাহী মহানগর যুবলীগে ঘরের ভেতরেই ‘সাইবার যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। গত ১৮-২০ ফেব্রুয়ারি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশ অনুযায়ী আগামী দিনে রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হতে আগ্রহী নেতারা নিজ নিজ জীবনবৃত্তান্ত জমা দিলে ফেসবুকে এই লড়াই চরমে ওঠে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রার্থিতাপ্রত্যাশী দুই নেতা তৌরিদ আল মাসুদ রনি ও আবদুল মোমিনের সমর্থকরা একের পর এক পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযোগে নেমে পড়েন।
শেষদিকে একজনের পক্ষ নিয়ে এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে যুক্ত হন যুবলীগের রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কেন্দ্রীয় নেতার ব্যক্তিগত সহকারীও।
তৌরিদ আল মাসুদ রনির সমর্থকরা নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল মোমিনের বিরুদ্ধে যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকার অভিযোগ তুলছেন।
অন্যদিকে, মোমিনের সমর্থকরা রনির বিরুদ্ধে রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও বিপুল অর্থ দিয়ে যুবলীগের পদ বাগানোর চেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন।
যুবলীগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৫ মার্চ সম্মেলনে রমজান আলীকে সভাপতি ও মোশাররফ হোসেন বাচ্চুকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই কমিটিই মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরও দায়িত্বে রয়েছে। সম্প্রতি ওয়ার্ড কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি তাগাদা দিলেও তা হয়নি।
এরপর সবশেষ পুরনো ওয়ার্ড কমিটি বহাল অবস্থাতেই নগর যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আগ্রহীদের জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয় কেন্দ্র থেকে। এর শেষ দিন ছিলো গত ২০ ফেব্রুয়ারি।
কেন্দ্রীয় যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সভাপতি পদে ১০ জন ও সাধারণ সম্পাদক পদে ১৭ জন জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন।
সূত্রমতে, দীর্ঘদিন ধরে নগর যুবলীগের সভাপতি পদে প্রার্থী হিসেবে জোর প্রচারণা চালিয়েছেন প্রভাবশালী ঠিকাদার তৌরিদ আল মাসুদ রনি। নির্ধারিত সময়সীমার শুরুর দিনেই ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন রনি। ১৯ ফেব্রুয়ারি জীবনবৃত্তান্ত জমা দেয়ার দ্বিতীয় দিন পর্যন্তও তার নেতাকর্মীরা তাকে আগামী দিনে নগর যুবলীগের নিশ্চিত সভাপতি হিসেবে উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিতে থাকেন।
কিন্তু শেষ দিন ২০ ফেব্রুয়ারি নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল মোমিনের পক্ষে সভাপতি পদে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেয়ার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে পরিস্থিতি বদলে যায়। রনি ও মোমিনের সমর্থকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিতে শুরু করেন।
সূত্র জানায়, প্রথম থেকেই রনির সমর্থকরা তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। এ অবস্থায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আবদুল মোমিন খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সভাপতি পদে জীবনবৃত্তান্ত জমা দেয়ার অনুমতি চান।
সেখান থেকে বেরিয়ে মোমিন জীবনবৃত্তান্ত জমা না দিলে সামাজিক মাধ্যমে মোমিনের অনুসারীদের লিখতে দেখা যায়- ‘রাজনীতিতে ত্যাগের চেয়ে কি টাকার ভূমিকা বড়?’ সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা ফেসবুকে লেখেন: ‘একমাত্র সিভি নাকি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বিপুল টাকায় কিনে নিয়েছে, যার রাজনীতি ৫ বছরের। সমগ্র মহানগরের ৯০ পার্সেন্ট জনসমর্থন যার আছে তার জন্য সান্ত্বনা, তুই চুপ থাক।
৩০ বছরের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যাওয়া ন্যায়ের বার্তা?’ জবাবে সাজ্জাদুর রহমান সুজন নামে রনির আরেক সমর্থক লিখেন: ‘টাকা তো সব নেতারই আছে। কিন্তু খরচ করে কয়জন? খরচ করতে কলিজা লাগে। খালি খাবেন আর সিন্দুকে ভরে রাখবেন এমন নেতা আমরা চাই না।’
পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে শেষ দিন মোমিনের জীবনবৃত্তান্ত দাখিল করার সঙ্গে সঙ্গে তার নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে শুরু করলে। রনির সমর্থকরা ফেসবুকে মোমিনকে ইঙ্গিত করে লিখতে শুরু করেন যে, তিনি ‘নেতা’র আদেশ অমান্য করেছেন। রনির সমর্থক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ দীপ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন: ‘নেতাকে মানি কিন্তু নেতার সিদ্ধান্ত মানি না। হায় রে নেতার লোক। হায় রে রাজনীতি।’ রনির আরেক সমর্থক মানিক ফেসবুকে মোমিনের উদ্দেশে স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেন: ‘রাজনীতি করবেন।
নেতার কমান্ড মানবেন না। এটা হতে পারে না।’ তিনি পৃথক স্ট্যাটাসে লিখেন: ‘রাজশাহী মহানগর যুবলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চায়, ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে নেতা নির্বাচিত করা হোক। যে কোনোদিন যুবলীগ করেনি, সেই ধরনের কোনো নেতাকে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেখতে চায় না ৩৭ ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা।’ জবাবে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মির্জা জনি স্ট্যাটাস দেন: ‘যাদের অতীত খুঁজলে এখনও পেটে বিএনপির টাকা পাওয়া যাবে, ফেসবুকে তাদের দালালি দেখে মনে হবে রাজনীতিতে তাদের না জানি কতোই অবদান।’
এ পরিস্থিতিতে তৌরিদ আল মাসুদ রনির সমর্থক মীর মিঠু তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মোমিনের উদ্দেশে লিখেন: ‘১২ বছর একটি সংগঠনের সভাপতি পদে থেকে (মহানগর ছাত্রলীগ) ১২টা ওয়ার্ডের কমিটি করতে পারেনি।
এখন আবার আরেকটি সংগঠনের ১২টা বাজানোর মিশনে নেমেছেন। মনে রাখবেন এটি যুবলীগ। কোনো সাফা কিরকিরা সংগঠন নয়।’ এরপর মোমিনের সমর্থকরা ফেসবুকে আরও লিখতে শুরু করেন রনিকে ইঙ্গিত করে। রাজন ইসলাম নামের মোমিনের একজন সমর্থক রনির উদ্দেশে লিখেন: ‘টাকার বাহাদুরী বেশিদিন চলবে না। টাকা বাদে কর্মী সমর্থক দেখান।
তাহলে বুঝবো আপনি নেতা হওয়ার যোগ্য।’ স্বপন রেজা নামের একজন রনিকে ইঙ্গিত করে স্ট্যাটাস দেন: ‘দুদিনের বৈরাগী ভাতেরে বলে অন্ন।’
সভাপতি প্রার্থী আবদুল মোমিনের একজন সমর্থক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিজের পথ পরিস্কার করার জন্য প্রভাব খাটিয়ে ওয়ার্ডের কমিটি করতে দেননি তৌরিদ আল মাসুদ রনি। অর্থ ও প্রভাব দেখিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওয়ার্ড কমিটির নেতাদের হাত করেছেন তিনি। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় যুবলীগের আঞ্চলিক দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতাকেও হাত করেছেন তিনি। ফলে বিপুল অর্থ ব্যয় করে আগামীতে যুবলীগের সভাপতি হতে সর্বোচ্চ নোংরামির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি——————