মোঃ আতাউর রহমান সরকার(মতলব প্রতিনিধি): কৃষির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অংশ হিসাবে মালেশিয়ার মাটিতে নিজ খামারে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তিনি তার জমিতে পতাকা উত্তোলন করেন। করেন ছোট্ট খাটো আয়োজন ও। দেশের প্রতি এ যেন তার চরম মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। বলছি জনপ্রিয় প্রবাসী সফল কৃষি উদ্যোক্তা মোতালেব খানের কথা।
২০০৭ সালে ভাগ্যের সন্ধানে শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার গোসাইপুর গ্রামের মোতালেব খান। মালেশিয়ার একটি ওয়ার্কশপের শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু মালয়েশিয়ায় গিয়ে সেখানকার খাদ্য তালিকার সাথে কোনভাবেই নিজের দেশের তালিকা মিলাতে পারছিলেন না। নিজের দেশের স্বাদ পেতে ওয়ার্কশপের পাশে কিছু সবজির বীজ রোপন করেন। তার মধ্যে দেশীয় স্বাদ পেয়ে আরো সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ওয়ার্কশপের এর পিছনে জঙ্গল পরিষ্কার করে তিন শতাংশ জমিতে নিজস্ব চাহিদা মেটানোর জন্য সবজি চাষ করেন। তার উৎপাদিত সবজি বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের মাঝে বিতরণ করতেন। এক সময় বাগানে পানি দেওয়ার সময় পানির বালতি নিয়ে পরে যান তখন তার মনে অনুভূতি জাগে আসলে আমি পরিশ্রম করে উৎপাদন করি, কিন্তু সব ফ্রি বিতরণ করছি কেন? তখনই তিনি কিছু সবজি বিক্রি করেন, বিক্রি করার পর ভালো সাড়া পান। তারপর কৃষির প্রতি তার অনুপ্রেরণা জাগ্রত হয় ফলে একশত রিংগিত দিয়ে মালাক্কা প্রদেশে ৩ একর জমি লিজ নেন,তখন তার হাতে ছিল মাত্র ১০২ রিংগিত। অতঃপর ওয়ার্কশপে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এবং ছুটির দিনে তার কৃষি খামারে কাজ করেন। সফলতা দেখে দুই বছরের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দেন। বাংলাদেশ থেকে বীজ এনে মালয়েশিয়ার মাটিতে একে একে সফল হতে শুরু করেন। তারপর শুরু হয় তার খামারের আকার বৃদ্ধি। বর্তমানে তার কৃষি জমির পরিমাণ ৩৫ একর। তিনি চাষ করছেন নানারকমের শাকসবজি। একেক দিকে চলছে একেক ফসলের উৎপাদন। মোতালেব খান এর কৃষি খামারে পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনব্যবস্থা সাজানো হয়েছে যেন বছরব্যাপী উৎপাদন নিশ্চিত থাকে সব ধরনের সবজি ফসলের। তাঁর শাকসবজি চাষের কৌশল দেখে মনে হয় ঈশ্বরদীর কালিকাপুর মডেলের বৃহৎ পরিসরে কৌশল অনুসরণ করে একেক জমিতে চাষ করছেন একেক সবজি ও শাকের। কলমি শাক, পুঁইশাক, লালশাক, সবুজ শাক, মূলা শাক, পাটেরশাক, বুঙ্গা শাক,ডাটা, শশা,ঢেড়স,বেগুন,টমেটু, করলা, চিচিঙগা, ধুন্ধল, তরমুজ,মিস্টিকুমড়া,মরিচ, কলা,ধনিয়াপাতা, লাউ, কুমড়া থেকে শুরু করে কচুও চাষ করছেন তিনি। প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে দৈনিক এক একটি জমি থেকে শাক উত্তোলন (হার্ভেস্ট) করেন, আবার একটি জমিতে নতুন করে শাকের বীজ বপন করেন। এভাবে একই শাকসব্জি তিনি অনেক জমিতে চাষ করছেন। আর প্রতিদিনই উৎপাদিত শাকসবজি বাজারে পাঠাচ্ছেন এবং নিজের প্রজেক্টে ও গাড়ি নিয়ে চলে আসছেন অনেক পাইকাররা।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ উৎপাদিত ফসলের বীজ আনা হয় দেশ থেকে। এখানে নিয়োজিত কর্মীরাও প্রায় সবাই বাংলাদেশি। কর্মরত মানুষ আর ফসলি মাঠ দেখে মনেই হয় না এটি মালয়েশিয়া। মনে হয় বাংলাদেশের কোনো এক গ্রামে আছেন । তার খামারে বর্তমানে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। প্রতি মাসে বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকার মতো আয় তাঁদের। খাবার খরচ নেই বললেই চলে, খামারে উৎপাদিত ফসল বিনামূল্যেই পাচ্ছেন তারা। নিজেরাই রান্না করছেন সব খরচ বাদে ৪০ হাজার টাকার মতো দেশে পাঠাতে পারছেন তারা। শুধু বাংলাদেশি নয় অন্যান্য দেশের কয়েকজনের ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন মোতালেব খান ।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাংলাদেশিদের হাতে রচিত হচ্ছে অন্যরকম কৃষি ক্ষেত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সবজি আবাদে বাংলাদেশিদের সাফল্য রয়েছে। দেখেছি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাঁরা একেক দেশে ঘটিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন কৃষিবিপ্লব। মালয়েশিয়ায়ও পরিত্যক্ত জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করছেন বাংলাদেশিরা। একেকজন বাংলাদেশিই যেখানে একেকজন সংগ্রামী কৃষিসৈনিক; রেমিট্যান্স যোদ্ধা। যাদের হাতে ফলছে সোনার ফসল। নিজের জন্মস্থান, বসতভিটা, সংসার, পরিবার-সন্তানের মায়া ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে দেশের মানুষের জন্য পাঠাচ্ছেন অর্থ।
একসময় অর্থকষ্টে ভুগতেন মোতালেব খান। তারপর কৃষি খামারই বদলে দিয়েছে তাঁর ভাগ্য। খান শুধু নিজেই ভালো থাকতে চান না। অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদে গড়েছেন বৃহৎ কৃষি খামার। আগামীতে বাড়াতে চান খামারের আয়তনও।
এছাড়া বাংলাদেশের অনলাইন গ্রুপ গুলোতে মোতালেব খান এর রয়েছে একটি বিশাল জনপ্রিয়তা। কৃষি উদ্যোক্তা খানভাই হিসাবে এক নামে চিনেন দেশের স্মার্ট কৃষি উদ্যোক্তারা। তিনি কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুরুপে। খান ভাই এগ্রিকালচার টিভি নামে তার একটি ইউটিউব চ্যানেল ও রয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি দেশের কৃষি খাতকে সম্প্রসারণের জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। বিনামূল্যে বাংলাদেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের মাঝে বীজ বিতরণ করেন। এতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে লাখো কৃষক।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যেও দেখেছি বাংলাদেশিদের বিশাল সবজি বাজার। সেখানে কৃষিপণ্যের বাজার নিশ্চয়তা তৈরি করেই কৃষি আবাদে নেমেছেন বাঙালিরা। এখানেও সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন খান সাহেবের মতো আরও অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা। সবজি, মাছ, মাংস বা ফল সব পণ্যেরই বাজার রয়েছে এখানে। বাংলাদেশিদের কাজের সম্ভাবনাও এখানে অনেক। তবে এ ক্ষেত্রে দরকার পর্যাপ্ত শ্রমিক। তবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক আনার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের এজেন্সি ও ব্যবস্থাপনার সংকটে লোকবল আনা কঠিন বলেন খান সাহেব।
আমরাও জানি, মালয়েশিয়া শ্রমবাজার, যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিকের। মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমবাজার নিশ্চিত করা, কৃষি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশিদের সম্ভাবনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার সঙ্গে। কথা বলে, এজেন্সি জটিলতা কমিয়ে কার্যক্রমের গতি বাড়ানো সম্ভব।