নির্বাচনের বছরে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশেনের কাউন্সিলরদের সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটে যেখানে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে, সেখানে খরচ বাড়ানোর এমন উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, নির্বাচনের বছরে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নানাভাবে সরকারের দরকার হবে। এ জন্য খুশি রাখারও একটা ব্যাপার থাকে।
দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর কাউন্সিলররা বর্তমানে মাসিক সম্মানী ভাতা পান ৩৫ হাজার টাকা। এই ভাতার অঙ্ক বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কার্যালয় ভাড়া ও অফিস ব্যবস্থাপনা ভাতা বাড়ানো হচ্ছে ১৪ হাজার। এ অনুযায়ী কেবল ঢাকার দুই সিটির কাউন্সিলরদের পেছনে ব্যয় হবে অতিরিক্ত প্রায় ছয় কোটি। এ দুই সিটিতে সংরক্ষিত ৪৩ নারী কাউন্সিলরসহ মোট কাউন্সিলরের সংখ্যা ১৭২।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মাসিক সম্মানী ও অন্যান্য ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব পাঠায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করে সুপারিশের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কাউন্সিলরদের ভাতা পুনর্নির্ধারণের জন্য সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
নির্বাচনের বছরে অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নানাভাবে সরকারের দরকার হবে। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে খুশি রাখারও একটা ব্যাপার থাকে।
মহসিন আলী, সমন্বয়কারী, গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম
ভোটের বছরে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সুবিধা বাড়াচ্ছে সরকার
কমিটির সুপারিশের বিষয়ে মতামত দিতে গত বছরের আগস্টে তা অর্থ বিভাগে পাঠায় স্থানীয় সরকার বিভাগ। অর্থ বিভাগ ১১টি বিষয়ে তথ্য চেয়ে পাঠায়। কমিটি সিটি করপোরেশনগুলোর কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্য একত্র করে একটি সমন্বিত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রস্তাব আকারে অর্থ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে।
গত ১২ জানুয়ারি ভাতা পুনর্নির্ধারণের কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ডিএসসিসি সচিব আকরামুজ্জামান বলেন, বর্তমানে সিটি করপোরেশনগুলোর রাজস্ব আয় তুলনামূলক বেড়েছে। প্রস্তাবিত হারে কাউন্সিলরদের সম্মানীসহ অন্যান্য ভাতা বাড়ানো হলে সিটি করপোরেশনগুলোর কোনো সমস্যা হবে না।
কতটা কী বাড়ছে
দেশে সিটি করপোরেশন রয়েছে ১২টি। সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা একই সম্মানী ভাতা (মাসিক ৩৫ হাজার টাকা) পান। এটা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার সুপারিশ করেছে কমিটি। এ ছাড়া প্রতি সভায় উপস্থিতির জন্য সম্মানী ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
ঢাকার দুই সিটির কাউন্সিলরদের কার্যালয় ভাড়া বাবদ ভাতা ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যান্য সিটির ক্ষেত্রে কার্যালয় ভাড়া ৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কার্যালয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের জন্য মাসিক ছয় হাজার টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এই খাতে ঢাকার দুই সিটিতে মাসিক চার হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। অন্যান্য সিটিতে এই খাতে কাউন্সিলররা দুই হাজার টাকা পেতেন।
কাউন্সিলরদের ভাতা পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, মর্যাদার দিক থেকে দেশের সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা সমান। সম্মানীর বিষয়টি সবার ক্ষেত্রে সমান রাখা হয়েছে। তবে স্থানভেদে কার্যালয় ভাড়া কম-বেশি করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনগুলোর বাজেট, বাস্তবতা ও অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে বেতন-ভাতা পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে।
অন্য জনপ্রতিনিধিদের অসন্তোষ
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ-সুবিধা পান। সবচেয়ে কম ভাতা ও সুবিধা পান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) জনপ্রতিনিধিরা। ইউপি সদস্যরা তাঁদের ভাতা বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। এ অবস্থায় যাঁরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের ভাতা আরও বাড়ানো নিয়ে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে একজন ইউপি সদস্যের মাসিক সম্মানী আট হাজার টাকা। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের অংশ ৪ হাজার ৪০০ টাকা, সরকারি অংশ ৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু অধিকাংশ ইউপিতেই সদস্যরা শুধু সরকারি অংশ পান। ইউপি সদস্যরা বলছেন, রাজস্ব আদায় ও ইউপির আয় কম—এসব কারণ দেখিয়ে সদস্যদের পুরো সম্মানী দেয় না পরিষদ।
সম্মানী বাড়ানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সংগঠন বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম। চেয়ারম্যানদের মাসিক সম্মানী ৪০ হাজার ও সদস্যদের সম্মানী ২০ হাজার টাকা করার দাবি তাদের। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানী একেবারেই অপ্রতুল। এর মধ্যে ইউপির অংশ না পাওয়ায় দৈনিক ১২০ টাকার কম সম্মানী পান সদস্যরা।
ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সবুর আলী সেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের (সদস্য) সম্মানীর নামে অসম্মান করা হচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ না করে যাঁরা বেশি সুবিধা পান, তাঁদের ভাতাই আবার বাড়ানো হচ্ছে। সরকার ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দুর্বল মনে করাতেই এমন পরিস্থিতি।’
‘নির্বাচনের বছরে অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে’
এর আগে ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের সম্মানী ভাতার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ভাতার বিষয়টি বলা ছিল। এবার শুধু সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের ভাতা পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা গভর্ন্যান্স অ্যাডভোকেসি ফোরাম। সংস্থাটির সমন্বয়কারী মহসিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইউপির সদস্যরা অবহেলিত। স্বাভাবিকভাবেই ইউপি সদস্যদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের প্রভাব ও ক্ষমতা বেশি হওয়ায় সিদ্ধান্তও তাঁদের পক্ষে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের বছরে অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের নানাভাবে সরকারের দরকার হবে। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে খুশি রাখারও একটা ব্যাপার থাকে।’