বাঙালির ঐতিহাসিক চিরকালীন গৌরবগাথা নিয়ে আমরা যা-ই বলি না কেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধিকারের আন্দোলন সংগ্রামই হবে এই জাতির প্রধান গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলা বা বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর গবেষণার সীমাহীন দলিলপত্র এখন আমাদের নাগালের মধ্যে জমা আছে। তথাপি সবকিছুকে ছাপিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তির আহ্বান ও মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধই এ জাতির সর্ববৃহৎ টার্নিং পয়েন্ট। স্মৃতির আয়নার ভেতরে বারংবার প্রতিবিম্বিত হয় সেই সময়কাল—
২. সেদিন দেশের প্রয়োজনে, জন্মভূমির ডাকে, মুক্তির অমোঘ টানে এবং এক অব্যর্থ আহ্বানে কারা জীবন বাজি রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অন্ধকারে গৃহহীন হয়েছিলেন? সে সময় যারা শূন্য হাতে গন্তব্যহীন, ঠিকানাহীন, বনবাদাড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার পথে বের হয়েছিলেন, তারা কি কোনো কিছুর প্রত্যাশায় এমন বুক বেঁধেছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সূর্যসন্তানদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কারা ছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের পরে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এমন হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় না-দেখা আজকের প্রজন্ম। অথচ ৫১ বছর আগে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় দিবসকে সচক্ষে অবলোকন করেছিলাম, আনন্দে উদ্বেলিত দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে আত্মহারা হয়েছিলাম, বুলেটের গগনবিদারী শব্দেও নিঃশঙ্কচিত্ত ছিলাম, এ প্রশ্নে আমাদের উত্তর কী হতে পারে?
বাংলাদের স্বাধীনতার তিন দশকের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশে-বিদেশে নানাবিধ গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়া সংখ্যাগুরু অকুতোভয়, দুরন্ত এ দামাল ছেলেরা কারা? এঁদের মূল ঠিকানা কোথায়? বাবা মায়ের পরিচয় কী? এঁদের শিক্ষা,স্বাস্থ্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা বা নিশ্চিন্ত অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান ছিল কী?
মোটা দাগে বললে, এমনকি গবেষণার ফলাফল সাক্ষ্য দেয়—তাদের এসব কিছুই ছিল না, স্কুলের গণ্ডিতেই আটকা পড়েছিল অধিকাংশ, স্কুল থেকে ঝরে পড়া বা মুষ্টিমেয় কেউ কেউ কলেজের দোরগোড়ায় পা রেখেছিলেন। এঁরা বেশির ভাগই অজপাড়াগাঁর ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক-কিষানির সন্তান ছিলেন। তারা পরিবারের জন্য যেমন বোঝা ছিলেন না, তেমনি ছিলেন না আয় রোজগারেরও অবলম্বন। তখনকার গ্রামবাংলার বাস্তব চিত্র বলে, এঁদের অনেকেই বাড়ি থেকে সন্তর্পণে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়। নেতৃত্ববিহীন অগস্ত্যযাত্রার মতো। ফিরে আসার কল্পনা মাথায় নিয়ে সেদিন তারা জন্মভিটা ছাড়েননি।
৩. বিপরীতক্রমে বয়স, সুযোগ এবং শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও যারা মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল বিভীষিকাময় দিনে মাতৃভূমির মাটির প্রয়োজনে ঘরছাড়া না হয়ে কেবল নিজের নয়, অন্যের ঘরও দখল করেছিল, এরা কারা? এদের পরিচয় কী? হ্যাঁ, এরাও বাঙালি। এ মাটিতেই এদের জন্ম। এদের কেউ কেউ সজ্ঞানে মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধার সরাসরি প্রতিপক্ষ হয়েছেন। তারা নরপিশাচদের সহযোগী হয়েছেন, দোসর হয়েছেন, দালাল সেজে ভোগবিলাস করেছেন, অত্যাচার নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের বাহক হয়েছেন। রাতারাতি চেয়ারম্যান, মেম্বার, থানার দারোগা বা সমাজপতি বনে গিয়ে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। বিজয়ের অব্যবহিত পরে সেই তারাই ভোল পালটে মিশে একাকার হয়ে যান সর্বত্র।
এদের ভাষায়-বলনে-কথনে-চলনে দ্রুত পরিবর্তন চলে আসে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান স্থপতি, মুখ্য কারিগর তথা অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এদের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের নীলনকশা ধরেই তারা এমন নারকীয় তাণ্ডব করেছিল। দেশ পুনরায় পাকিস্তানি হাওয়া বইতে থাকে। গা ঢাকা দেওয়া আন্ডার গ্রাউন্ডবাসীরা দিবালোকে উপবিষ্ট হতে শুরু করে।
প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করেনি যে, তারা আদৌ ভুল করেছে, শরমিন্দা হওয়া বা অনুশোচনার বদলে বরং অকপটে প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠ হয়ে বলেছে, তারাই সঠিক ছিল। সময়ের আবর্তে সবকিছু বদলে যায়, মানুষের স্মৃতিরও সীমাবদ্ধতা থাকে। তিন-চার দশকের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশের নদী-সাগরের প্রবহমান জোয়ার-ভাটার খেলায় মেতেছে অনেকেই। উত্থান-পতন এসেছে বারবার। সময় ও সুযোগের নিপুণ সন্ধানী এ চাটুকার প্রতিপক্ষরাই ধীরে ধীরে সপক্ষের বাহুবিস্তারের সারথি হয়ে ওঠে। এতদিন পরে বোঝা সহজ নয়, আসলে এরা কারা?
কেননা এদের সনদে, আইডি কার্ডে, পাসপোর্টে বা সরকারি তালিকায় কোনো ত্রুটি পাওয়া যায় না। অন্যদিকে, বানান ভুল, স্বাক্ষর অস্পষ্ট, সুপারিশ করা নেই, অফিসের বড় কর্তার সঙ্গে দহরম নেই, এসব কেবল সেই কৃষকের সন্তানের জন্য, যারা যুদ্ধে যেতে জানে, দেশের জন্যে মরতে জানে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে জানে!
৪. মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জীবনাচারের নানা কাহিনী আমার করোটিতে সারাক্ষণ কিলবিল করে। দিবানিশি ঘুরপাক খায় দিগিবদিক। বিদ্যুৎ বিলের ১৫০ টাকা পরিশোধের ব্যর্থতার দরুন একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ঘর অন্ধকার করে দেওয়ার কাহিনী। আমার ব্যথা অনুভূত হয় হৃদয়ের অদৃশ্য অজানা স্থানে। নিরন্তর রক্তক্ষরণের মতো অব্যক্ত বেদনাবিধুর সেই গল্প। যা কখনো সময় দিয়ে কেউ শুনতে যাবে না। অথচ পাঁচ দশকের বেশি সময় অতিক্রম করা দেশ এখনো মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করার প্রকল্প হাতে নিয়ে কাজ করে।
৫. সাবেক পাকিস্তান এলিট সার্ভিসের একজন সদস্য (সিএসপি) একসময় দেশের একটা বৃহত্তর জেলার প্রশাসক ছিলেন। তার জবানবন্দিতে বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরে তিনি তার জেলায় বিজয় দিবস উদযাপনের চমৎকার এক আনুষ্ঠানিকতা করেছিলেন। যথারীতি মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনারও আয়োজন হয়েছিল। এক মাস ধরে আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজির হলেন ৯২ জন। ৫০ বছর পরে আজকে সে জেলার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ৫০০ জন।
অথচ আমাদের জীবনকালের সবকিছুর সংখ্যা কমে যায়। কেবল এখানেই দেখা যায়, ক্রমাগত বৃদ্ধির নিত্যবর্ধিষ্ণু এক ফলবান তরু। আমি আশাবাদী, আমরাও নিশ্চয় একদিন থামব।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা নিয়ে গল্প-উপন্যাস, নাটক-নাটিকা, সিনেমা অনেক কিছু হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না। এমন ধৃষ্টতা এ জাতি কখনো প্রদর্শন করতে পারবে না। তবু ভাবি, যুগ যুগ ধরে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নানাবিধ আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় মর্যাদাগুলো যেন যথাসম্ভব সঠিক স্থানে, সঠিক মানুষটির হাতে পৌঁছে।
এমনকি তার পরবর্তী সঠিক বংশধরদের কল্যাণে আসে। এতে সময়ের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোও এক অনাবিল আনন্দ ও সান্ত্বনা খুঁজে পাবে। আমাদের রাষ্ট্রকে, সরকারকে, সমাজকে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে, প্রয়োজনে অপ্রিয় কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান, মর্যাদা ও তাৎপর্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা প্রতিটি জীবিত বাঙালির নৈতিক দায়িত্ব।