প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ খুলে দেবেন কাঙ্ক্ষিত দুয়ার।
স্বপ্ন থেকে স্পর্শের আঙ্গিনায় এখন মেট্রোরেল। চাইলেই ধরা যাবে। আজ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে সেই কল্পনা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ খুলে দেবেন কাঙ্ক্ষিত দুয়ার।
সাফল্যের পালক যোগ হলো সরকারের মুকুটে। শুরুর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রধানমন্ত্রী নিজেই হবেন প্রথম যাত্রী। উদ্বোধনের দিন ঘিরে রাজধানীতে সাজ সাজ রব। ঢাকাবাসীর দৃষ্টি উত্তরার দিয়াবাড়ীতে।
ফলে মেট্রোর যুগে প্রবেশ করবে দেশ। হবে মেট্রোরেলে কালজয়ী স্বপ্নপূরণ। এটা পদ্মা সেতুর মতো আরেকটি স্বপ্ন জয়ের গল্প। এভাবেই গর্বের অহংকারের আরেকটি মাইলফলক পেরোল দেশ।
তারা প্রহর গুনছেন কখন ঘুরবে চাকা, চলবে মেট্রো। আজ নয়, কাল থেকে গণমানুষের জন্য অত্যাধুনিক এই বৈদ্যুতিক গণপরিবহণ উন্মুক্ত হবে। উদ্বোধন কেন্দ্র করে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরো এলাকা ঢেকে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে।
উদ্বোধন উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের গর্ব ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মেট্রোরেল বাংলাদেশের নগর গণপরিবহণ ব্যবস্থায় একটি অনন্য মাইলফলক। উদ্বোধনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী আজ মেট্রোরেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৫০ টাকা মূল্যমানের স্মারক নোট অবমুক্ত করবেন।
উন্নত দেশগুলো বহু আগে মেট্রোরেল করলেও এর আগে বাংলাদেশের কোনো সরকার এটা নির্মাণের সাহস দেখায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের রূপান্তরের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ২০১২ সালে প্রকল্প অনুমোদন করেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। আজ প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক স্বপ্নজয়ের সেই দিন।
জানা গেছে, ঢাকার যানজট নিরসনে মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে লক্ষ্যে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) গঠন করা হয়। এই কোম্পানির মাধ্যমে প্রথম প্রকল্প হিসাবে নেওয়া হয় ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৬।
যা এমআরটি-৬ নামে পরিচিত। প্রকল্পটি উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এই প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। আজ উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের উদ্বোধন।
এই অংশের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ১০ মিনিট অন্তর চলবে এই ট্রেন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কোনো স্টেশনে না থেমে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১০ মিনিট এবং স্টেশনগুলোতে থেমে থেমে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৭ মিনিট।
প্রাথমিক পর্যায়ে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলবে। ট্রেনে নারীদের জন্য আলাদা কোচের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য স্কেলেটর, লিফটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেউ অসুস্থ হলে সেখান প্রাথমিক চিকিৎসাও দেওয়া যাবে।
মঙ্গলবার দুপুরে আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১১ নম্বর পর্যন্ত মেট্রোরেলের নিচের সড়ক সরেজমিন দেখা যায়, সড়ক বিভাজনগুলো সুন্দর করে সাজানোর কাজ চলছে। অর্ধেক অংশে নানা রঙের ফুলের গাছ রোপণ করা হয়েছে।
আর কিছু অংশে ফুল, লতাগুল্ম দিয়ে সাজানোর কাজ চলছে। বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত প্রধানমন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রীর ফেস্টুন নজর কাড়ছে নগরবাসীর। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১১ নম্বর সড়ক বিভাজনে টাঙানো ফেস্টুনে লেখা, ‘নিরাপদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও পরিবেশবান্ধব গণপরিবহণ মেট্রোরেল।’ ‘মেট্রোরেল জীবনে আনবে গতি, কমে যাবে যানজটের দুর্গতি’ এবং ‘এগিয়ে চলছে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক নির্মাণ, দুর্বার সময় এখন মাথা উচু করে দাঁড়াবার।’
মঙ্গলবার আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনের কনকোর্স হলে সংবাদ সম্মেলন করেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। বেলা ১১টার পর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আপানারা জানেন, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২।
বিজয়ের মাসের এই দিন বেলা ১১টায় বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের মেট্রোরেল বা এমআরটি লাইন-৬ এর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন হবে। আমাদের আশার বাতিঘর, সাহসের বর্ণিল ঠিকানা, রূপান্তরের রূপকার, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তরুণ প্রজন্মের মেট্রোরেলের উদ্বোধন করবেন। এছাড়া আমরা আশা করছি, আগামী বছরের ডিসেম্বরে এমআরটি-৬ এর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন হবে। আর ২০২৫ সালে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের উদ্বোধন করা হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর মতো এমআরটি-৬ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় একটি সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-এ ব্লক খেলার মাঠে এটা করা হবে। ১১টা ১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হবেন। ১১টা ৫ মিনিটে মেট্রোরেলের উদ্বোধনের নামফলক জনসম্মুখে উন্মোচন করবেন। ১১টা ২০ মিনিটে মোনাজাত করা হবে। পায়রা উড়ানো ও ফায়ার ওয়াক্স নিরাপত্তাজনিত কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে। সুধী সমাবেশ শুরু ১১টা ২৫ মিনিটে এবং প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করবেন দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক মেট্রোরেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। সভাপতিত্ব করবেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বাগত বক্তৃতা করবেন সড়ক পরিবহণ ও মহাড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লা নুরী এবং অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত শুভেচ্ছা বক্তৃতা করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার আগে সভাপতি বক্তৃতা করবেন, এরআগে এরিয়াল ভিডিও প্রদর্শনী, থিমসং পরিবেশন করা হবে। সমাবেশের বক্তৃতা শেষে প্রধানমন্ত্রী উত্তরা উত্তর স্টেশনে যাবেন, মূল ফলক পরিদর্শন এবং সেখানে একটি তেঁতুল গাছের চারা রোপণ করবেন। এরপর সিঁড়ি বেয়ে কনকর্স হলে পৌঁছাবেন। সেখানে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীকে এই হল সম্পর্কে ধারণা দেবেন।
এরপর টিকিট কেটে প্লাটফরমে যাবেন। সেখানে তিনি সবুজ পতাকা নাড়িয়ে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল চলাচলের শুভ সূচনা করবেন। স্মারক হিসাবে সবুজ পতাকায় প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করবেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর জন্য সংরক্ষিত মেট্রোর দরজার ফিতা কেটে তিনি ট্রেনের নির্ধারিত আসনে বসবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভ্রমণসঙ্গী হবেন ২০০ জন আমন্ত্রিত অতিথি। তাদের সঙ্গে তিনি কুশল বিনিময় করবেন। ট্রেন আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনে পৌঁছালে তিনি নেমে যাবেন। সেখান থেকে আসবেন গণভবনে।
উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের ভাড়া লাগবে ৬০ টাকা। প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৫ টাকা এবং সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। মেট্রোরেলে ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
তবে যারা র্যাপিড পাশ বা এমআরটি পাশ ব্যবহার করবেন তারা ১০ ভাগ ছাড় পাবেন। এছাড়া এমআরটি-৬ এ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিনা ভাড়ায় চলাচল করবেন।
প্রতিবন্ধীরা এককভাবে চলাচলের সময় ভাড়া ১৫ ভাগ ছাড় পাবেন। আর তিন ফুট পর্যন্ত উচ্চতার শিশুদের অভিভাবকদের সঙ্গে চলাচলের সময় ভাড়ার প্রয়োজন হবে না।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এমআরটি-৬ এর ভাড়া বেশি নির্ধারণ সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএল’র এমডি এমএএন সিদ্দিক বলেন, কোন সময় ঢাকায় মেট্রোরেল তৈরি করা হয়েছে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভাড়ার সঙ্গে তুলনা করতে হবে। কলকাতার মেট্রোরেল অনেক আগে নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে সুবিধাও অনেক কম। আমাদের মেট্রোরেলে আধুনিকমানের এবং এখানে অনেক বেশি সুবিধা রয়েছে।
আমাদের মেট্রোরেল অনেক সময় সাশ্রয়ী। বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা গেছে, যানজটের কারণে যে শ্রমঘণ্টার ক্ষতি হতো তার আর্থিক পরিমাণ ৪০ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা। মেট্রোর কারণে সেই অর্থ সাশ্রয় হবে।
তিনি বলেন, এটা একটি বৈদ্যুতিক ট্রেন। বিদ্যুৎ খরচের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কোনো দেশের মেট্রোরেলের ভাড়ার সঙ্গে ঢাকার মেট্রোরেলের ভাড়ার তুলনা করার আগে সেখানকার বিদ্যুৎ খরচের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এসব তুলনা করলে দেখবেন, এটা সর্বনিম্ন ভাড়া। এই ভাড়া আদায় করেও মেট্রোরেল লাভজনকভাবে পরিচালনা করা যাবে না। এজন্য আমরা স্টেশন প্লাজা ও টিওডি নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। সেই আয় থেকে ভাড়া বাবদ ৩০-৩৫ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হবে।
ভাড়া বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী বলেন, এখন ঢাকা সিটিতে যে অবস্থা; কেউ উত্তরা থেকে কমলাপুর আসতে ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা। কত সময়ে আসবে ৩৮ থেকে ৪০ মিনিটে। ভাড়া এমন একটি বিষয় প্রথমে কেউ এটি গ্রহণ করে না। কিন্তু, বাস্তবে সবাই গ্রহণ করবে। এখন সর্বনিম্ন রিকশা ভাড়াও ২০ টাকা।
ডিএমটিসিএল’র এমডি বলেন, সব মেট্রো স্টেশন প্রস্তুত। মানুষের অভ্যস্ততার জন্য এটা করা হয়েছে। মানুষ যত দ্রুত অভ্যস্ত হবে, তত দ্রুত অন্যান্য স্টেশনগুলোও চালু করা হবে। ২৬ মার্চ সব স্টেশনে যাত্রী উঠানামার জন্য খুলে দেওয়া হবে।
স্টেশন : মেট্রো স্টেশনগুলো হলো-উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, মতিঝিল এবং কমলাপুর।
সরকার ২০১২ সালে মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করে। বাস্তবে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে রয়েছে-জাপান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। শুরুতে প্রকল্পের আকার ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, কিছু স্টেশনে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শকের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়তি ভ্যাটের কারণে আরও প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের লাইন-৬ এর খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাইকা দিচ্ছে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। আর সরকার এই প্রকল্পে খরচ করছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।