সীমান্ত নিয়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি মিয়ানমার বারবার ভঙ্গ করছে। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত এলাকা তুমব্রুর পরিস্থিতি চরম উত্তেজনাময় হয়ে আছে। গত প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে সীমান্তের এপারে (বাংলাদেশ সীমান্ত রেখার অভ্যন্তরে) শুক্রবার ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া, গোলা ও মর্টারশেল এসে পড়ার পর রাতে ঘুমধুম, বেতবুনিয়া ও তুমব্রু এলাকায় আকাশসীমা একাধিকবার লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার যুদ্ধবিমান। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমারকে সতর্ক করার ৫ দিনের মাথায় ফের মর্টারশেল পড়েছে তুমব্রুতে।
সর্বশেষ শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সীমান্তের ওই এলাকায় তুমুল গোলাগুলির শব্দে এলাকার লোকজন ব্যাপক আতঙ্কে রয়েছে। সীমান্তের ওপারের তুমব্রু, ওয়ালিদং, কক্ষধঙ্গ্যা, ফকিরাবাজার ও সাহাব বাজার এলাকায় সে দেশের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে বলে সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এ অবস্থায় তুমব্রুর ওপারে নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থানরত ৪ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা তটস্থ থেকে যে কোন মুহূর্তে ফাঁকফোকর দিয়ে এপারে চলে আসতে পারে আশঙ্কায় বিজিবি সীমান্তে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলবৎ রেখেছে। তুমব্রুর ওপারে মিয়ানমারের শূন্য রেখার আশ্রয়শিবির থেকে একটি রোহিঙ্গা পরিবার এপারে চলে আসলে বিজিবি সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুশব্যাক করেছে।
সীমান্তের এপারে গোলাবারুদ এসে না পড়া এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন না করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার ৫ দিনের মাথায় আবারও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার পর দেশটির যুদ্ধবিমানের ঘুমধুম, বেতবুনিয়া, তুমব্রু এলাকার আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দূরে রেখে নিয়মিতভাবে সীমান্তে গুলি-মর্টারশেল ইত্যাদি ছুড়ে মিয়ানমার পক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে গ-গোল সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে কি না- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে, মিয়ানমার পক্ষ পরিকল্পিতভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের এ দেশে ঠেলে দেয়ার পর নতুন পরিকল্পনায় দাবার চাল দিচ্ছে কি না? তুমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে অবস্থানরত সাড়ে ৪ হাজারসহ রাখাইন রাজ্যে অবশিষ্ট ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে উৎখাত করতে চাইছে কি না? আর যদি তাই হয়, এদের গন্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশ যে হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই- এমন আশঙ্কা ঘণীভূত হয়েছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে তুমব্রুর সীমান্ত এলাকা থেকে ৭০টিরও বেশি পরিবার নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে শনিবার।
মর্টারশেল নিক্ষেপের ঘটনা ॥ শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের কোনাপাড়ার জিরো পয়েন্টে অস্থায়ী রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমার পক্ষের নিক্ষেপিত মর্টারশেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ৬ রোহিঙ্গা হতাহতের হওয়ার পর শনিবার সকাল থেকে সীমান্তের ওই এলাকা গোলাগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রকম্পিত হয়েছে।
সীমান্তের এপারে নেতিবাচক প্রভাব ॥ রাখাইন রাজ্যে মাসাধিককাল ধরে চলমান সংঘর্ষে এপারের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাসমূহে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে রয়েছে। জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা এলাকা থেকে কিছু মানুষ ইতোমধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে, উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, শূন্য রেখা ও রাখাইন রাজ্যে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদেরকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে।
ঘটনার পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার পক্ষ কোন ধরনের ফ্লাগ মিটিং করেনি। জানা গেছে, তুমব্রু সীমান্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। অনুরূপ সংঘর্ষ চলছে মিয়ানমারের কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে।
জিরো লাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা ঢুকে যেতে পারে ॥ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিত্যকার গুলি ছোড়া এবং অনতিদূরে তুমুল যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ওপারের তুমব্রুর কোনারপাড়া জিরো লাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যে কোন মুহূর্তে এপারে প্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারে। গত শুক্রবার রাতে রোহিঙ্গা বস্তিতে গুলি ছোড়ায় এক রোহিঙ্গা নিহত ও শিশুসহ ৫ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর থেকে ঐ বস্তির রোহিঙ্গাদের মাঝে সীামন্ত অতিক্রমের তৎপরতা লক্ষ্যণীয়।
বস্তি থেকে একটি পরিবার শনিবার বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে বিজিবি তাদের পুশব্যাক করেছে বলে জানা গেছে। স্থানীয়রাও বিজিবির কাছে জোরালো দাবি তুলেছেন, যেন আর কোন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ না পারে। তুমব্রুর কোনারপাড়া জিরো লাইনে অবস্থিত রোহিঙ্গা বস্তির নেতা দিল মোহাম্মদ জানিয়েছেন, জিরো লাইনের বস্তিতে তাদের জীবন সঙ্কটময়। তারা ইতোমধ্যে এপারে যাতে চলে আসতে পারে সে জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
সীমান্ত এলাকা থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে ॥ সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে ঘুমধুম সীমান্ত থেকে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষা কেন্দ্রটি উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ওই কেন্দ্রের এসএসসি পরীক্ষার শিক্ষার্থী মোট ৪৯৯ জন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হওয়ায় কেন্দ্রটি শুক্রবার রাতে জরুরী নির্দেশনা দিয়ে ঘুমধুম থেকে উখিয়া স্থানান্তর করে বান্দরবান জেলা প্রশাসন। শনিবার সকাল ৯টা থেকেই মিনিবাস, সিএনজিযোগে ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে স্থানান্তরিত কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আসতে থাকে। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাইরুল বশর জানিয়েছেন, ১০টি কক্ষে সকাল ১১টা থেকে পরীক্ষা শুরু হয়ে চলে দুপুর একটা পর্যন্ত। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়, বালুখালী কাশেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে বাংলা ২য় পত্র বিষয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে।
উখিয়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি বাস ফ্রি দেয়া হয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় ঘুমধুম কেন্দ্র সরিয়ে কুতুপালং কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়ে পরীক্ষার্থীরা।
উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, বরাদ্দকৃত বাস দুটি যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন হবে ততক্ষণ স্ট্যান্ডবাই থাকবে। পরীক্ষা দিতে আসা ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার জানায়, পরীক্ষা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমাদের এলাকার অবস্থা ভাল না। সকালেও কেন্দ্রে আসার সময় গুলির শব্দ শুনেছি।
উদ্বেগ নিয়ে পরীক্ষা দিল ঘুমধুমের শিক্ষার্থীরা ॥
কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাংলা ২য় পত্রের পরীক্ষায় শনিবার অংশ নেয় ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪১৬ শিক্ষার্থী। বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের এসব শিক্ষার্থী কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার একটি কেন্দ্রে শনিবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার্থী ৪১৯ জন হলেও শনিবার অংশ নিয়েছে ৪১৬ জন। এদেরকেই বাসযোগে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়ার জন্য দুটি বাসের ব্যবস্থা করেছে উখিয়া থানা পুলিশ।
চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে মাইন বিস্ফোরণে আহতের ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার তুমব্রু সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত উইনু থোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা (২৩) চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার চিকিৎসা চলছে। তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হবে। শুক্রবার বিকেলে আহত উইনুকে প্রথমে কুতুপালং, এরপর কক্সবাজার হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় রাত ৮টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
উইনু থোয়াইং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের অংক্য থোয়াইন তঞ্চঙ্গ্যার ছেলে। জানা গেছে, শূন্যরেখার ৩৫ নম্বর পিলারের কাঁটাতারের কাছে শুক্রবার বিকেলে গরু আনতে গিয়ে মাইনে পা দিলেই স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হন। তার বাম পায়ের গোড়ালি নিচ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ওপারের কোন নাগরিকের অনুপ্রবেশ নয় ॥ উখিয়া থেকে সংবাদদাতা জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা-সহিংসতার কারণে বাংলাদেশ সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে তুমব্রুর সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ৭০টিরও বেশি পরিবার অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
শনিবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা, পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী ও বিজিবি কর্মকর্তাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সীমান্ত এলাকার পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে এ সিদ্ধান্ত নেন।