সোমবার (৬ জুন) রাজধানীর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মেলন কক্ষে “বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা: সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা” শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। ঢাকা শহরের ১ হাজার ৮১১ জনের ওপর জ’রিপ চালিয়ে এ তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে বিআইডিএস। অনুষ্ঠানে প্রধান অ’তিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
বিনায়ক সেন বলেন, আমাদের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী দেশে প্রথম লকডাউনের সময় দারিদ্র্যের হার ছিলো ৪২ শতাংশ। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ শুরু হলে এ হার নামে ৩৬ শতাংশে। ওমিক্রনের সময় সেটা আরও কমে দাঁড়ায় ২১ শতাংশে। বর্তমানে এ হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জ’রিপে বলা হয়েছিলো, করোনার অ’ভিঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জ’রিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মা’র্চ পর্যন্ত দেশে এ নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।
করোনা মহামারি শুরুর আগে দেশে নগর দারিদ্র্যতার হার ছিলো ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ এসময়ে নগরজীবনে দারিদ্র্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পিপিআরসি চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বর্তমানে দারিদ্র্যতার সংখ্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমি বিনায়ন সেনের তথ্য শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে, আমরা সঠিক পথে আছি। বিআইডিএস দুই হাজারের কম হাউজহোল্ডের ওপর একটি গবেষণা করে দেখিয়েছে, ওই খানাদের মাঝে দারিদ্র্যতা দ্বিগুণ হয়েছে। তার মানে করোনাকালে দারিদ্র্যের একটা অবনতি হয়েছে। মাত্রা নিয়ে একটা বিতর্ক হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে দারিদ্রতা বেড়েছে। এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি, কিন্তু এই রুমের বাইরে গেলে আমরা বেশ কিছ দৃশ্যমান উদাহরণ দেখতে পাবো। কিন্তু এটি ভাববার বিষয় যে, করোনা মহামা’রির এতো বড় একটা ঘটনার পরও সরকার কেন দারিদ্র্যতা নিয়ে একটা জরিপ করতে পারলো না। যদি করতো তাহলে আমরা দেখতে পারতাম আসলে কোথায় সমস্যা।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, এ দেশের মানুষ কষ্ট করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কিন্তু সে মানুষগুলোই ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে একটা ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তবে সেটা সার্বিকভাবে না, সমাজের উচ্চবিত্তদের মাঝে এ ঐকমত্য হয়েছে। আর সে ঐকমত্য হচ্ছে, নিয়মের কোনো প্রয়োজন নেই, যেনতেনভাবে অর্থনৈতিক গ্রো করতে হবে।তিনি বলেন, সেটার উত্তম উদাহরণ সীতাকুণ্ডে কনটেইনার বিস্ফোরণ। সেখানে নিয়মের বালাই ছিলো না, তবে গ্রোথ হয়েছে। গ্রোথ হয়েছে ফসল আসছে জিডিপিও বাড়ছে, তবে সব নিয়মনীতিভাবে। কিন্তু দারিদ্র্যতার বিষয়টি হচ্ছে চুইয়ে পড়া অর্থনীতি। তারা অর্থনীতির সুফল পাচ্ছে চুইয়ে পড়া পানির মতো করে। উচ্চবিত্তদের ঐকমত্যে নিয়মনীতি বড় নয়, অর্থনীতির গ্রো-ই সর্বাগ্রে।
সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আধুনিক বিশ্বে বৈষম্যকে ভোগ, সম্পদ দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। এখানে অন্য বিষয়গুলো আসে। যখন বিনিয়োগ ও কর আহরণের বিষয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আনা হয়। ক্রমবর্তমান বৈষম্য ২০১০ এবং ২০১৫ খানাভিত্তিক জরিপে দেখা যায়, সেখানে আয়ভিত্তিক বৈষম্য বেড়েছে। সাত বছরের ডেটা নেই। তবে মাঠ পর্যায়ের ডেটা থেকে দেখছি, বহুমাত্রিক বৈষম্যের বিষয়টি প্রকট আকারে এসেছে। মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হয়নি।
তিনি বলেন, আমি মনে করি বৈষম্যের বিষয়টি আরেকটু প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ, অতিমাত্রায় বৈষম্য বাড়লে প্রবৃদ্ধিও হুমকিতে পড়ে। একদিকে সামাজিক সুরক্ষা হচ্ছে অন্যদিকে বিদেশে টাকা পাচার করা অর্থ বৈধভাবে দেশে ফেরানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তবে মধ্যবিত্তদের জন্য সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের বৈকল্য রয়েছে।
এসময় সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের এখন আগ্রহ বেড়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন যাই বলি না কেন এর মূলে রয়েছে বিনিয়োগ। গার্মেন্ট শিল্প ভালো করেছে, তবে এ খাতের সক্ষমতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। যেসব অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, তবে আমাদের অনেক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে আমরা অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করতে পারছি না। সামনে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়বো কি না, সে বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে।অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।