“পশুর জীবন থেকে মানুষের ভালোবাসাময় সমাজের সংগ্রামই ‘জীবনের রঙ’ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়।” এ উপন্যাসে সমাজের সমগ্রিক বাস্তবতাই চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ হলেও এটি সমস্ত শোষিত, অমানবিক এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে একদিকে অমানবিক, স্বার্থপর, ভণ্ডরা সাধারণ মানুষদের শোষণ করে, আবার সাধারণ মানুষরা তা নির্দ্বিধায় মেনেও নেয়। কেননা তাদের কাছে- “সু’নীতি আর কু’নীতি হোক, নেতৃত্ব দানকারী সমাজপতিরাই তাদের নেতা! তাদের মনোবাসনাই সমাজের নিয়ম।” কিন্তু অপরদিকে কিছু স্বল্পসংখ্যক মানুষের প্রচেষ্টায় মানবিক ও নৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ চলতে থাকে ‘মানুষের পাঠশালা’ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রং মিয়া হলেও উপন্যাসটি রং মিয়ার ছেলে বৃন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়। যদিও উপন্যাসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রং মিয়া চরিত্র অনুপস্থিত তবুও তার ‘মানুষ চরিত্রের মানুষ গড়ার আদর্শই’ সমগ্র উপন্যাস জুড়ে প্রতিভাত হয়। উপন্যাসে এক এক জীবনের এক এক রঙ প্রদর্শিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রং মিয়া, বৃন্ত, পীরসাহেব বর্ষা, কুলসুম, খনকার, জুতাবাবা, প্রসূণা চরিত্রগুলো এক একটি জীবনধাঁধার বিচিত্র রঙ।
গ্রামীণ সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করতে সরকারের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েও রং মিয়া গ্রামে বাস করেন। কেননা তার মতে- এক-দুদিনের সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ও দু-চারটি নীতি বাক্যের মাধ্যমে মানুষের চরিত্র বদল করা যায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষগুলো প্রচলিত নিয়মের বাইরে চিন্তাও করতে পারে না। ফলে কেউ সঠিক বললে তাদের কাছে তা অনিয়ম বলেই মনে হয়। তাই রং মিয়ার বাতিক্রমী চিন্তাধারাও সবাই মেনে নিতে পারে নি।
“যদি দক্ষিণের বাতাস বয়ে যায়,
কিন্তু সবাই যদি বলে উত্তরের বাতাস বইছে,
আর সেখানে একজন যদি তার গায়ে বাতাসের অনুভব টের পেয়ে
বলে বাতাস দক্ষিণ দিক থেকেই বইছে,
তাহলে সে একজনকে সবার কাছে পাগলই মনে হবে!”
সমাজ, কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই রং মিয়া নিজের মানুষ দর্শন ও স্বদেশ দর্শন প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেই প্রচলিত ধারার কাছে হেঁয়ালি হয়ে যান। ফলে অনিয়মের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে ২০ বছর আগে চাকরি, সমাজ, সংসার সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান তিনি।
“মানুষ কেন মানুষেরে চিনে না,
মানুষ না হারাইলে মানুষ মিলে না।”
অন্যদিকে, ২০ বছর ধরে বাবাহীন বৃন্তকে তার মা কুলসুম খুব কষ্ট করে মানুষ করে। বৃন্তের মধ্যেও তার বাবার আদর্শ পরিলক্ষিত হয় কিন্তু মায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে বৃন্ত নীরব থাকে। মাঝেমধ্যে বৃন্তের সাথে বিভিন্ন ছদ্মবেশে পীরসাহেব বর্ষার দেখা হয়। পীরসাহেব বর্ষার আচরণ তাকে ভাবিয়ে তুলে, পীরসাহেব বর্ষাকে তার কাছে রহস্যজনক মনে হয়।পীরসাহেব বর্ষার প্রভাবে বৃন্ত সমাজের সর্বত্র অমানবিক আর অনিয়মের দিকটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তাই বৃন্তের মতে- “একজন পাগলও তার মনের কথা নির্ভয়ে বলে বেড়াতে পারে। অথচ একজন ভালো মানুষ তার ভালো কথাটাও বলতে পারে না এ সমাজে!”
একসময় তাদের গ্রাম থেকে ভালো ছেলেমেয়েদের গুম করা শুরু হয়। বৃন্তকেও গুম করা হয়। তারপর বৃন্ত নিজেকে জঙ্গলের ভেতর ‘মানুষের পাঠশালা’ নামক এক পাঠশালায় আবিষ্কার করে। এ পাঠশালার মূল উদ্দেশ্য- মানুষের মতো মানুষ গড়ে সমাজে প্রেরণ করা যাতে সমাজটা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
বিবেক ও মানবিকতার জন্য মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বলা হয়। কিন্তু বর্তমানে মানুষ আর পশু চরিত্র আলাদা করা কঠিন। তাই মানুষরূপী পশুদের সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রকৃত মানুষ হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘু। সত্যিকারের হোমোসেপিয়েন্সদের বিপন্ন অবস্থা থেকে বাঁচাতে এ পাঠশালা প্রতিষ্ঠা।
এ পাঠশালা মানুষের চরিত্রগত উন্নয়নের জন্য দু’পদ্ধতি আবিষ্কার করে-
একটি- ব্যবহারিক কার্যক্রমে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আচরণিক প্রক্রিয়া শুরু করা। প্রতিটি অভ্যাসে নৈতিকতা, মানবিকতা, সততা ও সহনশীলতার আচরণের চর্চা শুরু করলে এর প্রভাব সমাজ ও সংসারে পড়বে। এক্ষেত্রে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়াকে গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা পালন করতে হবে।
অন্যটি- DNA Technology। কিছু মানুষের উপর স্টাডি করে সেখান থেকে যাদের মধ্যে মানুষ চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়; তাদের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে, তাদের মধ্যে জিনট্রান্সফার করে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা। কিন্তু এটি ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ। আর এর সফলতা আর ব্যর্থতা দুটোই হতে পারে।
এ পাঠশালায় বৃন্ত তার হারানো বাবাকে খুঁজে পায়। রং মিয়া এ পাঠশালায় মানুষ চরিত্রের মানুষ গড়ার জন্য ২০ বছর আগে সমাজ, সংসার ছেড়ে জঙ্গলে পীরসাহেব বর্ষার সাথে আসেন। কিন্তু বৃন্তের মতে সমাজে থেকেই মানুষের চরিত্র গঠনের কাজ করা যায়। পীরসাহেব বর্ষা রং মিয়াকে বলেন- “মানুষের জন্য যে মানুষ চিন্তা করে, যে মানুষ নিজে মানুষ চরিত্র ধারণ করে, তাঁর বংশধর অমানুষ হতে পারে না! আপনার ক্রোমোজোম বিশুদ্ধ, বৃন্তই তার প্রমাণ।” তারপর পীরসাহেব বর্ষা রং মিয়াকে বাড়ি ফেরার অনুমতি দিলেন।
“পীরসাহেব বর্ষার কথা শুনে রং মিয়া জীবন বাঁকের রঙ উপলব্ধির গভীর মগ্নতায় বৃন্তের দিকে মায়ার চোখে তাকালেন।”
এ উপন্যাসে সমাজের স্বার্থপর, অমানবিক বাস্তবতা তুলে ধরার পাশাপাশি তা থেকে মুক্তির পথও দেখানো হয়েছে। তাই পশুর সমাজ থেকে মানুষের সমাজ গঠনের জন্য এ উপন্যাসটি পড়ার অনুরোধ রইলো।
লেখকঃমোসলেম উদ্দিন সাগর
বুক রিভিউয়ারঃ মৌমিতা দত্ত
প্রকাশকালঃফেব্রুয়ারি ২০২০(১ম প্রকাশ)
প্রকাশনাঃ আগামী