চাঁদপুরের মতলব উত্তরে মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষিজমিতে অপরিকল্পিত ভাবে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, নিষ্কাশন খালে কচুরিভাগারে আবদ্ধ- খাল ভরাট করে বাড়িঘর রাস্তা নির্মাণ এর ফলে জলবদ্ধতার শিকার হয়ে কৃষকেরা নিঃস্ব । চাঁদপুরের মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের কৃষিজমিতে নিয়ম লঙ্ঘন করে ব্যাপকহারে ঘরবাড়ি গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে প্রকল্পে অন্তত ছয়হাজার হেক্টর কৃষিজমি কমে গেছে, কমেছে ফসল উৎপাদনও। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি তৈরি অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে প্রকল্পটি আবাসন প্রকল্পে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে মতলব উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। বর্তমানে প্রকল্পটির আওতায় ১৪ টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা রয়েছে।নির্মাণকালে প্রকল্পে জমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৫৮৪ হেক্টর। এর মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার হেক্টর। শুরুতে সেচ পৌঁছানো হয় প্রকল্পের পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে। চলতি বছর সেচসুবিধা দেওয়া হবে ছয় হাজার ৭০০ হেক্টরে। প্রকল্প নির্মাণের সময় ১৩ হাজার হেক্টর কৃষিজমি থাকলেও ৩৩ বছরে ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় ২০২১ সালে এর পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার হেক্টর প্রায়। বাকি অন্তত পাঁচ হাজার হেক্টর কৃষিজমির বেশির ভাগে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও কিছু জমি চলে গেছে বাজার, অপরিকল্পিত বাগান,অফিস ও রাস্তাঘাট নির্মাণে।
প্রকল্পে ২০১৫ সালে ধানি জমির পরিমাণ ছিল আট হাজার হেক্টর ও উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার টন। ২০২১ সালে আবাদকৃত জমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় সাত হাজার হেক্টরে ও ফসল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ হাজার টন। আবাদি জমি কমে যাওয়ায় ফসল উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। এটা খুবই চিন্তার বিষয়।
এদিকে ২০২১ সালে টানা দুই দুইবার আকস্মিক জলবদ্ধতার শিকার হয়ে কৃষকেরা নিঃস্ব হয়েছে।
কতৃপক্ষের খাল খননের কোন কার্যক্রম হাতে নেয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে কৃষি উদ্যোক্তারা ভবিষ্যত কৃষি নিয়ে শঙ্কায় আছেন। কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অনেকেই। যা বেকারত্ব সমস্যা চরমে নিয়ে যাবে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছে, মতলব উত্তরে প্রতিদিন কোটি টাকার সবজি আমদানি করতে হয়, ফলে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি সহ মানসম্মত নিরাপদ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকা বাসী।
অথচ মতলব উত্তরে মেঘনা ধনাগোদা সেচপ্রকল্পে একটি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে এটা সবজির জন্য বিখ্যাত হতো।নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যেতো। কারণ, চারপাশে বেড়িবাঁধ বেষ্টিত এবং দুইটি সেচ ও নিষ্কাশন পাম্প রয়েছে, যার মাধ্যমে শুকনা মৌসুমে পানি সেচ ও বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব। কিন্তু গত ৩৩ বছরে ৫৬১ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল পুনখননে কোন পরিকল্পনা হাতে না নেওয়ার কারণে রপ্তানির পরিবর্তে আমদানি করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কৃষকেরা জমি চাষাবাদ করে লোকসানের কবলে পড়ায় কৃষিজমিতে কাঠবাগান ও বসতবাড়ি নির্মাণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রকল্পের দক্ষিণ ও উত্তর ফতেপুর, টরকি,ঠেটালিয়া, লুধুয়া, গজরা, আবুরকান্দি, মান্দারতলি, ঘনিয়ারপাড়, সিপাইকান্দি, রাঢ়িকান্দি, ছৈয়ালকান্দি, বড় ও ছোট হলদিয়া, নাউরী, ওটারচর, নবুরকান্দিসহ আরও অনেক এলাকায় কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি। জমির মার্জিনাল উচ্চতায় গড়ে ওঠা এসব বাড়ির আশপাশের জমিগুলোও নষ্ট হচ্ছে মানুষের পথ চলাচলের রাস্তা ও অন্যান্য কাজে। বাড়িতে লাগানো বড় বড় গাছের ছায়ায় ফসল হচ্ছে না। প্রকল্পের ভেতর প্রবেশ করে মনে হয়েছে, এটি যতটুকু না সেচ প্রকল্প, তার চেয়ে বেশি আবাসন প্রকল্প।
গজরা ইউনিয়ন এর খাককান্দা গ্রামের নবীর হোসেন জানান, ‘তিনি ১৬ শতাংশ কৃষিজমি নিয়ে একখানা পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। যার মূল কারণ হচ্ছে ঠিকমতো ফসল না পাওয়া। এদিকে দুলালকান্দি গ্রামের উত্তর পাশে গত কয়েদিন পূর্বে ২০ একরের বিশাল মাঠের মধ্যবর্তী মাঠে ঠাই নিয়েছেন এক নবনির্মিত বসতবাড়ি।যা এই মাঠটি ধবংস করতে যথেষ্ট। কম উচ্চতায়, কম খরচে, সুন্দর ও আলাদা পরিবেশে বসবাসের উদ্দেশ্যে বাড়ি করেছেন।
কৃষিজমি নষ্ট করে লোকজন যেভাবে বাড়ি বানাচ্ছে, তাতে প্রকল্প নির্মাণের আসল উদ্দেশ্যই বিফলে যাচ্ছে। জমিতে ঘন ঘন বাড়ি তৈরি বন্ধ হওয়া দরকার। ওটারচর এর কৃষক মোঃ আতাউর রহমান বলেন,এভাবে অপরিকল্পিত বনায়ন, বসতবাড়ি তৈরি করতে থাকলে কয়েক বছর পর কৃষিজমি হারিয়ে যাবে।এতে বেকারত্ব ও নিরাপদ খাদ্য ঘাটতি দেখা দিবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, আইন মোতাবেক যেকোনো জমি শ্রেণী পরিবর্তন করতে সরকারের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের এ আইন তোয়াক্কা করছে না প্রকল্পের কেউ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমার জমিনে আমি বাড়ি বানাব, এতে সরকারের কী বলার আছে?’
প্রকল্পের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ধারনা, মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই প্রকল্পের কৃষিজমিতে এত অধিকহারে ঘরবাড়ি হচ্ছে। এ ব্যাপারে সবারই সচেতনতা দরকার। নির্বাহী প্রকৌশলীর মতে প্রকল্পে বাড়িঘর তৈরি বন্ধে পাউবোর নিজস্ব কোনো আইন নেই। এ সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে প্রকল্পের বাসিন্দারা। এদিকে উপজেলা কৃষক ও জমির মালিক ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সচেতন করার জন্য অনবরত কাজ করে যাচ্ছে ” কৃষি উদ্যোক্তা পরিষদ মতলব উত্তর উপজেলা, চাঁদপুর” এর সকল সদস্যগণ। তাদের মতে এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে এ প্রকল্পটি আবাসন প্রকল্পে রূপ নিতে পারে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়।