সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীই নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। রবিার রাতে ভোট গণনার পর ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এতে বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দারকে ৬৯ হাজার ১০২ ভোটে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো নাসিক মেয়র নির্বাচিত হন নৌকা প্রতীকের সেলিনা হায়াত আইভী। এ নির্বাচনে আইভী পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ ভোট। আর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলম পেয়েছেন ৯২ হাজার ১৭১ ভোট। মেয়র আইভীর হেট্টিক বিজয়ে তার কর্মীসমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। নৌকা নৌকা স্লোগানে মুখরিত হয় নারায়নগঞ্জ শহর।
এর আগে প্রার্থী এবং ভোটারদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে টানা ভোটগ্রহণ। কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটাররা স্বতস্ফুর্তভাবে লম্বা লাইনে দাড়িয়ে ভোট দেন। দিন যত বাড়ে ভোটারদের উপস্থিতিও তত বাড়ে। নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে ভোটগ্রহণকালে কোন ধরণের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকারসহ সব প্রার্থীই বলেছেন, সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। এই নির্বাচন সর্বমহলের প্রশংসা অর্জন করেছে। এর মাধ্য দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের উদাহরণ সৃষ্টি করলো নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এবার নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হয়। এটি নতুন পদ্ধতি হওয়ায় কারো কারো কাছে ইভিএমে ভোটদান প্রক্রিয়া ছিল জটিল। তাই ভোটদানে কিছুটা ধীর গতি ছিল। ইভিএমে ভোট দিতে কম বয়সীদের চেয়ে বয়স্কদের একটু সময় বেশি লেগেছে। এছাড়া কেউ কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে না নেয়ায় এবং কারো কারো আঙ্গুলের ছাঁপ না মেলায় ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্ভনার শিকার হয়েছেন। তবে শেষ দিকে ভোটদানের গতি কিছুটা বাড়ে। বিকেল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্র কেন্দ্রে গণনার পর ফলাফল ঘোষণা করা হয়। পরে সব কেন্দ্রের ভোটের হিসেব যোগ করে রির্টার্নিং কর্মকর্তা মেয়র ও কাউন্সিলর পদে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন।
নারায়নগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ এবং মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা এবারের নাসিক নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেন। এ ছাড়া আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তাই নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। প্রর্থীদের কর্মী সমর্থকরা প্রতিটি অলি-গলি ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে বয়স্ক ভোটারদের বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রে এনে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ কারণেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশি। আর পরষ্পরবিরোধী প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করায় সার্বিক পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর।
৫ ধাপের ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল ব্যাপক সমালোচনা করে। এ কারণে এই কমিশন কিছুটা বেকায়দায় ছিলেন। এই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ একেবারে শেষ প্রান্তে এসে নাসিক নির্বাচন ছিল তাদের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। তাই নাসিক নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীকে তৎপরতা জোরদার করার নির্দেশ দেয়। এরই অংশ হিসেবে ভোটের আগের দিন থেকেই নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয় সমগ্র সিটি কর্পোরেশন এলাকা। অবশেষে ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকায় এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। ভোট চলাকালে সকল প্রার্থী, ভোটার এবং নারায়নগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ক’দিন আগেই বলেছিলেন নাসিক নির্বাচন একটি মডেল নির্বাচন হিসেবে উদাহরণ হয়ে থাকবে। আর রবিবার ভোটের দিন নারায়নগঞ্জের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, নাসিক নির্বাচন আমাদের কমিশনের সর্বোত্তম নির্বাচন।
নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ভোটের আগের দিন থেকেই কঠোর নিরাপত্তাবলয়ে আনা হয় পুরো নির্বাচনী এলাকা। র্যাব, বিজিবি, পুলিশের স্পেশাল টিম রবোকপ, সাধারণ পুলিশ, আর্মড পুলিশ, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার টিম মাঠে নামানো হয়। আর এভাবেই নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয় সমগ্র নারায়নগঞ্জ এলাকা।
রবিবার অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচনে ২৭ ওয়ার্ডের ১৯২ ভোটকেন্দের সব ক’টিতেই ভোট হয় ইভিএমে। সব কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষ ছিল ১ হাজার ৩৩৩টি। এবারের নির্বাচনে ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। ২০১৬ সালে ভোটার ছিল ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। এবার নতুন ভোটার ৪২ হাজার ৪৩০ জন। আর এবার নারী ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন। এই নতুন ও নারী ভোটারদের অধিকাংশই ভোট দিয়েছেন। আর তাদের ভোটেই নির্বাচনের ফলাফলে অনেক প্রভাব পড়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আ্ওয়ামী লীগের আইভীর সঙ্গে বিএনপির মেয়র প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার। আইভী পেয়েছিলেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট, আর বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছিলেন ৯৬ হাজার।
এবার নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করেছেন ৭জন। এছাড়া সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছেন ১৪৫ জন প্রার্থী। মেয়র পদে নির্বাচন করেন আগের দুইবারের মেয়র আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী (নৌকা), স্বতন্ত্র থেকে বিএনপির সাবেক নেতা তৈমূর আলম খন্দকার (হাতি), খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন (দেওয়াল ঘড়ি), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মো. রাশেদ ফেরদৌস (হাত ঘড়ি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ (হাত পাখা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসীম উদ্দিন (বটগাছ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম (ঘোড়া)।
২০১১ সালে নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর পর এবার ছিল তৃতীয় নির্বাচন। গতবছর ৩০ নবেম্বর নাসিক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হওয়ার আগে শুক্রবার কেন্দ্রে কেন্দ্রে ইভিএমে মক ভোটের মহড়া হয়। এর আগে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় নাসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে। আর ২০১১ সালে প্রথম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডে ভোট হয় ইভিএমে, আর অন্যান্য কেন্দ্রে ভোট হয় ব্যালট পেপারে।
নাসিক নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ১৯২টি ভোটকেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে ছিল ৩ স্তরের নিরাপত্তা। সার্কিক নিরাপত্তার জন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫ হাজারের বেশি সদস্য নিয়োজিত ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিল ২৬ জন ফোর্স। এর বাইরে ছিল পুলিশ ও র্যাবের স্ট্রাইকিং ফোর্স। ২৭টি ওয়ার্ডে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে ৩০টি মোবাইল কোর্ট কাজ করে। এ ছাড়া ১৪ প্লটুন বিজিবি মাঠে কাজ করে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি করে টিম কাজ করেছে। ছিল র্যাবের একটি করে টিম। ২৭ কেন্দ্রে পুলিশ ছিল ৩ হাজারেরও বেশি। এছাড়াও পুলিশের মোবাইল টিম ছিল ৭৬টি, যার প্রতি টিমে সদস্য ছিল ৫জন করে। আর র্যাবের টিম ছিল ৬৫টি। এছাড়া শনিবার সকাল থেকেই নারায়নগঞ্জ শহরের প্রতিটি অলি-গলি ও রাজপথের মোড়ে বিপুল সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। আইনশৃংখলা বাহিনীর ভ্রাম্যমান টিমগুলোও সমগ্র শহরে মহড়া দেয়।
দেশে আবার করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভোটের দিন সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে সেভাবে স্বাস্থ্য বিধি মানা হয়নি। বিশেষ করে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটারদের ভিড় থাকায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি।
এদিকে রবিবার ভোট দেয়ার পর দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে সাংবাদিকদের কাছে জানান। নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভী বেলা ১০ টা ৫০ মিনিটে ভোট দেন শিশুবাগ এলাকার আলী আহমেদ চুনকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তাই বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। আমি হেরে গেলেও ফলাফল মেনে নেবো। আইভী বলেন, আমি জানি নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমাকে বেছে নিয়েছে। তারা অলরেডি নির্ধারণ করে নিয়েছে কাকে ভোট দেবে। ইনশাআল্লাহ আইভীর জয় হবেই হবে, নৌকার জয় হবেই হবে। গণজোয়ারের জয় হবেই হবে।
এর আগে সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ভোট দিয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হাতী প্রতীকের মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচন ষুষ্ঠু হয়েছে তাই আমি লক্ষাধিক ভোটে বিজয়ী হবো। তবে একটি কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্ট বের করে দেয়া হয়েছে। আমার ৭ জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইভিএম প্রসঙ্গে তৈমুর বলেন, ইভিএম খুবই স্লো। কোথাও কোথাও ইভিএম মেশিন হ্যাঙ্গ হয়েছে।
এদিকে নাসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাকে নিয়ে এতোদিন বিভিন্ন মহল বিভিন্নমুখী কথা বলেছেন সেই আওয়ামী লীগ নেতা ও নারায়নগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান বিকেল সাড়ে ৩টায় নারায়নগঞ্জ আদর্শ স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেয়ার পর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমি সারা জীবন নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করেছি। শেখ হাসিনার সৈনিক হিসেবে বলতে পারি নৌকার মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী হারবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে জানিয়ে শামীম ওসমান বলেন, এ জন্য আইনশৃংখলা বাহিনী ও সাংবাকিসহ নারায়নগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, নারায়নগঞ্জ বাংলাদেশের অংশ। তাই বাংলাদেশে যে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় নাসিক নির্বাচন এর উদাহরণ।
নাসিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে করেছে ৯ সংস্থার ৪২ জন পর্যবেক্ষক। সংস্থাগুলো হলো-জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন, সমাজ উন্নয়ন প্রয়াস, তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থা, তালতলা যুব উন্নয়ন সংগঠন, রিহাব ফাউন্ডেশন, বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশন এবং মানবাধিকার ও সমাজ উন্নয়ন সংস্থা (মওসুস)। নির্বাচন পর্যবেক্ষরাও বলেছেন নাসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।