২০১১ সালের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ফেলানী। এই হত্যাকাণ্ডে ভারত আন্তর্জাতিকভাবে চাপে পড়লেও এখনও সীমান্তে বিএসএফের অমানবিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি। ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিএসএফের হাতে ফেলানীসহ কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী উপজেলায় অন্তত ২৮ জন বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নিহতরা হলেন, কুড়িগ্রামের ফুলাবাড়ীতে ২০১১ সালে ফেলানী, একই সালে মিঠু মিয়া, ২০১২ সালে আলমগীর হোসেন, ২০১৪ সামচুল হক ও মুকুল মিয়া, ২০১৫ সালে শ্যামল চন্দ্র বাদ্যকার, একই বছরে উলিপুরে বায়েজিদ হোসেন, ২০১৯ সালে ভারতীয় নাগরিক সবুর মিয়া, নাগেশ্বরীতে ২০১৯ সালে আবুল হাসেম, ২০২০ সালে ছবিল উদ্দিন ও জামাল উদ্দিন, একই বছর রৌমারীতে হাসিনুর রহমান, ২০১৬ সালে ফুলু মিয়া, তাহারুল ইসলাম, নুরল আমিন, নুর ইসলাম, বাহারুল ইসলাম, মনসের আলী, ২০২০ সালে খয়বর আলী, শাহিনুর রহমান ফকির চাঁদ, আখিরুল ইসলাম, ২০২১সালে হাসিবুর রহমান, সহিবর রহমান, রাশেদুল ইসলাম এবং ভারতীয় নাগরিক মোহাম্মদ আলী, ২০১৬ সালে ভূরুঙ্গামারীতে আব্দুল বারেক, ২০১৭ সালে জাহাঙ্গীর আলম ও ২০১৯ সালে ভারতীয় নাগরিক আখেরুল ইসলাম।
ফেলানী হত্যা ছাড়া ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালে দুই ভারতীয় নাগরিক ও ২৫ বাংলাদেশির বিএসএফের গুলিতে নিহতের বিচার বিষয়ে বহির্বিশ্বে ব্যাপক কোনো আলোচনা হয়নি।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নূর ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতের আসাম রাজ্যের বোয়াইলপাড়া জেলার বঙ্গাইগাও এলাকায়। কিশোরী ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয় বাংলাদেশে। ২০১১ সালে ৭ জানুয়ারী বিয়ের উদ্দেশ্যে বাবার সঙ্গে ভারত থেকে দেশে আসার সময় কিশোরী ফেলানীকে ভারতীয় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মইয়ের উপরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে কাঁটাতারে উল্টোভাবে ঝুঁলে পড়ে যায় ফেলানী। এসময় ফেলানীর বাবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেমে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। প্রায় আধা ঘণ্টা ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ফেলানী। সকাল পৌনে ৭টা থেকে নিথর দেহ কাঁটাতাঁরের উপর ঝুলে থাকে দীর্ঘ সাড়ে ৪ ঘণ্টা ধরে। করুণ এই দৃশ্য গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এরপর বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। বিএসএফের কোর্টে স্বাক্ষী দেন ফেলানীর বাবা ও মামা হানিফ। পরের মাসে ৬ সেপ্টেম্বর আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিএসএফের বিশেষ কোর্ট। রায় প্রত্যাখান করে পুনরায় বিচারের দাবি জানান ফেলানীর বাবা। পরের বছর ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনঃবিচার শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে স্বাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা। ২০১৫ সালের ২ জুলাই এ আদালত পুনরায় আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষ আবারও বেকসুর খালাস পায়। এই রায়েও সন্তুষ্ট হতে না পেরে ওই বছর ১৪ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ ‘মাসুম’ ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রীম কোর্টে রিট পিটিশন করে। ওই বছর ৬ অক্টোবর রিট শুনানী শুরু হয়। ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কয়েক দফা শুনানী পিছিয়ে যায়। পরে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনা শুরুর আগে শুনানীর দিন ধার্য হলেও শুনানী হয়নি এখনও। এদিকে মেয়ের হত্যাকারীর বিচার না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেন ফেলানীর পরিবার।
পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ফেলানীর রক্ত বৃথা যায়নি। ফেলানী হত্যার আগে সীমান্তে ট্রিগার ফ্রি ছিল। এখন বিএসএফ গুলি করলে জবাবদিহিতার মুখে পড়ে। আগে যেমন নিত্য খুন-খারাপি ছিল সেটা কমে এসেছে। এটা একটা আমাদের প্রাপ্তির জায়গা বলে মনে করি। কিন্তু ফেলানী হত্যা ঘিরে ন্যায় বিচার পাইনি, আমরা সেটার অপেক্ষায় আছি।