উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক উপজেলা থেকে গত বছর ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন লামিয়া সুলতানা (ছদ্মনাম)। পরের দিন ২৪ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় রাজধানীর একটি কেন্দ্রে সমাজসেবা অধিদফতরের সমাজকর্মী (ইউনিয়ন) নিয়োগ পরীক্ষা ছিল তার।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের চাকরি প্রার্থী লামিয়ার চাকরির বয়সও প্রায় শেষ। ফলে ২০১৮ সালের আবেদন করা এ নিয়োগ পরীক্ষায় তার প্রস্তুতি ছিল সর্বোচ্চ। পরীক্ষায় অংশ নিতে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে টেবিলে বসতেই বিটিভির স্ক্রলে দেখতে পান ‘অনিবার্যকারণে’ ওই নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
ক্ষোভ ও হতাশায় ভেঙে পড়েন লামিয়া। এ অবস্থা শুধু তার একার নয়; সারা দেশের সাড়ে ৬ লাখ চাকরি প্রার্থীর। এর আগে ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একইভাবে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করেছিল সমবায় অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির সমাজকর্মীর ৩ হাজার ২০০টি পদের মধ্যে ৭৯৯টি পদই খালি। এসব শূন্যপদে নিয়োগ দিতে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই ৪৬৩টি পদে লোকবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে আবেদন জমা পড়ে ৬ লাখ ৬২ হাজার ২৭০টি।
দুই দফা পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এ পরীক্ষাসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে সরকারের খরচ হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ ২১ হাজার টাকা। যা পুরোটাই জলে গেছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে তাও বলতে পারছেন না অধিদফতরের কর্তাব্যক্তিরা। এমনকি পরীক্ষা কেন বারবার স্থগিত হচ্ছে তা নিয়েও মুখ খুলছেন না মন্ত্রণালয়ের কর্তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) শেখ রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরীক্ষা না হলেও সার্বিক প্রস্তুতি ছিল আমাদের।
গত ২৪ ডিসেম্বরের পরীক্ষা নিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও ধামরাইয়ের মোট ৩৭৩টি পরীক্ষা কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এসব কারণে অনেক টাকাই খরচ হয়েছে।’ কেন পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে? এ বিষয়ে কোনো তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কি না? তিনি এর জবাব না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (প্রশাসন)-এর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে সমাজসেবা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) সৈয়দ মো. নুরুল বাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘বিষয়টি আমারও জানা নেই। পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা স্থগিত করতে বলা হয়। পরে আমরা নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করার নির্দেশ দিই। এ বিষয়ে কোনো ধরনের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে আধাঘণ্টা পরে কথা বলব’। এরপর ফোন দিলেও তিনি আর প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে সমাজকল্যাণ সচিব মাহফুজা আখতারকে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে এসএমএস করা হলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি। অভিযোগ উঠেছে, সমাজসেবা অধিদফতরের নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে তার দফতরের একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটে মন্ত্রীর পরিবারের একজন সদস্যের নামও শোনা যায়।
সম্প্রতি এ নিয়ে একাধিক পত্র-পত্রিকায়ও সংবাদ ছাপা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এ সিন্ডিকেটের হয়ে অধিদফতরে কাজ করেন একজন সহকারী পরিচালক। যিনি ২০১৭ সালে সমাজসেবা অধিদফতরে প্রশাসন-২ শাখায় সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর থেকে অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, গাড়িচালক, ফিল্ড সুপারভাইজার, সহকারী হিসাবরক্ষক, বাবুর্চি পদে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। মন্ত্রণালয়ের ওই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ থাকায় বরাবরই প্রতিটি নিয়োগ কমিটির সদস্য থাকেন ওই সহকারী পরিচালক।
সম্প্রতি তার নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে বলা হয়েছে, এবারের সমাজকর্মী নিয়োগে শত কোটি টাকা বাণিজ্য করার ছক চূড়ান্ত হয়েছিল। এ খবর জানাজানি হলে নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আসে। ইতোমধ্যে ওই সিন্ডিকেটে একাধিক সদস্যকে দফতর বদল করে দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর ছাপা হয়েছে তার বেশির ভাগই সত্য।