অবশেষে রাজশাহী নার্সিং কলেজের সাবেক প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা, অধ্যক্ষ সেফালী খাতুন এবং মনিজ্জা বেগম ও সাদেকা খাতুনের সরকারী অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে। এ কলেজের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রাজশাহী মহানগরীর জনৈক এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেন। দুদক, দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরই প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি (উপ-সচিব, মাহবুবুর রহমান) গত বুধবার সকাল থেকে রাজশাহী নার্সিং কলেজে সরেজমিন তদন্ত শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, রাজশাহী নার্সিং কলেজের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রাজশাহী মহানগরীর জনৈক এক ব্যক্তি দুদক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি উল্লেক করেন, রাজশাহী নার্সিং কলেজের তৎকালীন প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা, অধ্যক্ষ সেফালী খাতুন এবং সাবেক অধ্যক্ষ মনিজ্জা বেগম ও সাদেকা খাতুনের সাথে যোগ-সাজস করে বিভিন্ন কেনাকাটার সরকারী অর্থ আত্মসাৎ, অর্থের বিনিয়ে নিলাম বিধি না মেনে নামমাত্র মূল্যে গোপনে পুরাতন মালামাল বিক্রি, অতিরিক্ত ভর্তি ফি’ আদায়, শিক্ষার্থীদের ৩২ সিটের কোস্টার গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। অভিযোগে বলা হয়, অধ্যক্ষ সেফালী খাতুন একাডেমিক কমিটি বা স্টাফ কাউন্সিল গঠন না করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা এবং বিশ^বিদ্যালয়ের সব পরীক্ষার প্রশ্ন সেটার, মডারেটর, ভিজিলেন্সসহ আর্থিক সংশ্লিষ্ট সব কাজেই তিনি ( শেফালী খাতুন) এবং তার অনুগত ৫-৬ জন শিক্ষককে নিয়োজিত করে কলেজ পরিচালনা করেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নার্সিং অধিদপ্তর থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দ এনে টেন্ডার ছাড়াই নামকা ওয়াস্তে কেনাকাটা করে সরকারী অর্থ আত্মসাত করেন অধ্যক্ষ ও প্রধান সহকারী। এ লুটপাট শুরু হয় মূলত ২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে। ঐ অর্থ বছরে তৎকালীন অধ্যক্ষ সাদেকা খাতুনের বিরুদ্ধে বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় ৬৮ লক্ষ টাকার অডিট আপত্তি হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত অডিট অধিদপ্তরের আপত্তিপত্রে বলা হয়, আসবাবপত্র, অফিস সরঞ্জামসহ আনুসঙ্গিক উপকরণ বাবদ ৩২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৫৫ টাকা খরচ দেখানো হলেও বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি, যা আত্মসাত করা হয়েছে। এরপর একইপত্রে ১৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ১১৬ টাকা নিস্পত্তি এবং অবশিষ্ট ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৫৫০ টাকার মালামাল না কিনে ব্যয় প্রদর্শনের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করতে বলে অডিট অধিদপ্তর কিন্তু তৎকালীন অধ্যক্ষ সাদেকা খাতুন সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে অর্থ ফেরত ছাড়াই অডিট অধিদপ্তরে ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি দিয়ে পার পেয়ে যান। সাদেকা খাতুন পার পেয়ে যাওয়ায় পরবর্তী অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুনও তার আমলে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে তারচেয়েও বেশি বার্ষিক বরাদ্দ এনে একই কায়দায় আত্মসাত করেছেন।
অধ্যক্ষ সেফালী খাতুনও কেনাকাটার অর্থ একইভাবে আত্মসাত করছেন। আর এসব লুটপাটের নাটের গুরু হলেন প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক গোলাম মোস্তফা। যখন যিনি অধ্যক্ষ হন, তাকেই অর্থের বিনিময়ে কব্জা করেন গোলাম মোস্তফা। এরপর যোগসাজস করে নার্সিং অধিদপ্তর থেকে অতিরিক্ত বার্ষিক বরাদ্দ এনে টেন্ডার ছাড়াই কেনাকাটার নামে আত্মসাত করেন। এক্ষেত্রে ৫/১০ বছরেও নষ্ট হয় না, এমন একই মালামাল বারবার ভাউচারের মাধ্যমে ক্রয় দেখানো হয়। শুধু তাই নয়, পুরাতন মালামাল মেরামত করেও নতুনভাবে ক্রয় দেখানো হয়। এছাড়া বার্ষিক বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব কলেজের সংশ্লিষ্ট কাউকে জানতে দেয়া হয় না। গোলাম মোস্তফা ছোট পদে চাকরি করেও ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানে মেয়েকে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ান। রাজশাহীর তানোরে ৭০ বিঘা জমি কিনেছেন। রাজশাহী শহরের চন্দ্রিমা এলাকায় চারতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়িসহ বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত বার্ষিক বরাদ্দ, মালামাল ক্রয়ের টেন্ডার ও ক্রয় কমিটি, স্টক রেজিস্টার ও সরজমিনে মালামাল যাচাই করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, অধ্যক্ষ শেফালী খাতুন, নার্সিং ইনস্ট্রাক্টর মাহাফুজা খাতুন এবং প্রধান সহকারী গোলাম মোস্তফা যোগসাজস করে প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকার পুরাতন মালামাল নিলাম বিধি না মেনে গোপনে মাত্র ৪০,৩৩০টাকায় পছন্দের ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেছে। এছাড়াও প্রথম বর্ষ ভর্তিতে শিক্ষার্থী প্রতি ৯৮১০ টাকা আদায় করেছেন, যা আগে ছিল ৮৫০০ টাকা। এরমধ্যে শিক্ষা বোর্ডে সনদপত্র ও নম্বরপত্র যাচাইয়ের নামে ৮০০টাকা আদায় করা হলেও কোন সনদ যাচাই না করে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কলেজে কমনরুম না থাকলেও ৪০০টাকা করে ফি’ নেয়া হয়েছে।
অভিযেগে আরও বলা হয়, রাজশাহী নার্সিং কলেজের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক সমাচার পত্রিকাসহ একাধিক জাতীয় পত্রিকায় সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। নার্সিং অধিদপ্তর দু’বার তদন্তও করেছে। কিন্তু তাদের কিছুই হয়নি, অদৃশ্য ক্ষমতার জোরে সব কিছু ম্যানেজ করে ফেলেন । অধিপ্তরের তদন্ত কমিটি দুর্নীতির প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ বা বাস্তব যাচাই-বাছাই না করে ‘আই-ওয়াশ’ তদন্ত করে তাদের রক্ষা করেছে। এমনকি তদন্ত কমিটি অভিযুক্তদের সামনে সাধারণ শিক্ষকদের উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করে বিব্রত করেন।