লাখো মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শহরের রাজেন্দ্র কলেজ ময়দানে জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের। প্রিয় মানুষদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় কমলাপুরস্থ ময়েজমঞ্জিলে তাঁর পিতা চৌধুরী ইউসুফ আলী মোহন মিয়ার কবরের পাশে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। শেষবারের মতো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দুরদুরান্ত হতে মানুষ ছুটে আসেন।
আজ শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) বাদ জুমা দুপুর সোয়া দুইটার দিকে রাজেন্দ্র কলেজ ময়দানে একটি হিমবাহী গাড়িতে করে ময়েজমঞ্জিল হতে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের লাশ আনা হয়। এসময় সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জানাযায় অংশ নিতে ফরিদপুর ছাড়াও দুরদুরান্ত হতে মানুষ ছুটে আসেন। বেলা ৩টার দিকে শহরের চকবাজার জামে মসজিদের খতিব ও সামমুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি মাওলানা কামরুজ্জামানের ইমামতিতে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। প্রিয় নেতার দাফন কার্যে অংশ নিতে আগত জনতার পদচারণায় এসময় সেখানে তিল ধারণের ঠাই ছিল না। রাজেন্দ্র কলেজ মাঠ ছাড়িয়ে এসময় পাশর্^বর্তী ফরিদপুর শেখ জামাল স্টেডিয়াম পর্যন্ত ছিল মুসুল্লীদের ভিড়।
জানাযাপূর্ব সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন পরিবারের পক্ষ হতে মরহুমের জেষ্ঠ্য মেয়ে চৌধুরী নায়াব ইবনে ইউসুফ, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, শরিয়তপুরের বাহাদুরপুর দরবার শরীফের প্রতিনিধি হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ হানজেলা, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া, এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি শিল্পপতি এ কে আজাদ, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকু, ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি মাহবুবুল হাসান ভুঁইয়া পিংকু, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৈয়দ মোদাররেস আলী ঈসা, অধ্যাপক এবিএম সাত্তার, জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যাপক আব্দুত তাওয়াব প্রমূখ। এছাড়া এসময় ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুস সামাদের পক্ষ হতে একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান শেখ ফরিদ জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বক্তাগণ সাবেক এই জনপ্রিয় রাজনীতিবীদ ও সংসদ সদস্য চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, তিনি ছিলেন প্রকৃতই একজন সজ্জন চরিত্রের জননেতা। তাঁর প্রতিপক্ষ বা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধেও তিনি কখনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করতেন না। তিনি পাঁচবার ফরিদপুর সদর আসন হতে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। বিএনপি যতোবার সরকার গঠন করেছে ততোবারই তিনি মন্ত্রী হয়েছেন।
তারা বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে তিনি জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিতে এসে সারাজীবন জনগণের জন্য কাজ করে গেছেন। শুধু বাংলাদেশই নয়, বহিঃবিশে^ও তিনি আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ও সৎ রাজনীতিবীদ হিসেবে হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। রাজনীতিতে নেমে এমপি মন্ত্রী হয়েও তিনি কখনোই অর্থসম্পদ গড়ে তোলার মানসিকতা পোষণ করতেন না।
চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের জেষ্ঠ্য মেয়ে চৌধুরী নায়াব ইবনে ইউসুফ জানাযাপূর্ব তাঁর আবেগঘণ ও কান্নাজড়িত বক্তব্যে তাঁর পিতার জন্য সকলের কাছে দোয়া চান। জানাযায় অংশ নিতে দুরদুরান্ত হতে ছুটে আসা সকলের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, আমার পিতা ও পূর্ব পুরুষেরা যেভাবে আপনাদের সুখে-দুঃখে আপনাদের পাশে থেকেছেন, ইনশাআল্লাহ আগামীতেও আমি সেভাবে আপনাদের পাশে থাকার চেষ্টা করবো।
জানাযার পর রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ হতে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। এসময় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষ হতে ছাড়াও জেলা বিএনপির পক্ষ হতে মোদাররেস আলী ঈসা, জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন, কোতয়ালী থানা বিএনপি, শহর বিএনপি, রাজবাড়ি ও মাদারিপুর জেলা বিএনপি, জেলা যুবদল, মহানগর যুবদল, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দল, জেলা তাতী দল, জেলা ছাত্রদল, মহানগর ছাত্রদল, ফরিদপুর প্রেসক্লাব, চকবাজার বণিক সমিতিসত বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ হতে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হয়।
জানাযা শেষে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে রাজেন্দ্র কলেজ ময়দান হতে তাঁর লাশ ময়েজমঞ্জিলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁকে দাফন করা হয় পিতা চৌধুরী ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার কবরের পাশে।
প্রসঙ্গত, গত ৮ অক্টোবর ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। এর আগে গত ১৯ নভেম্বর নিউমিয়াজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় তাঁর করোনা সনাক্ত হয়। এরপর এক সপ্তাহ যাবত সিসিইউতে লাইফ সাপোর্ট থাকার পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে ফরিদপুরে শোকের ছায়া নেমে আসে।
চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন থেকে পাঁচ দফা সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি যে কয়বার সরকার গঠন করেছেন ততবারই তিনি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মে তিনি ফরিদপুর জেলার সম্ভ্রান্ত বাঙালি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূবপুরুষ ফরিদপুরের জনমানুষের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে জনসেবার উজ্জল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে ধারণ করে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফও একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবীদ হিসেবে আমৃত্যু মানুষের পাশে থেকেছেন। তাঁর বিদায় বেলায় লাখো মানুষ তাঁর এই অবদানের প্রতি শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন