চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার বদরপুর আকবর আলী খান উচ্চ বিদ্যালয় এর ব্যবস্থাপনা কমিটির কথিত সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ মিলেছে। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারনে ঐতিহ্যবাহি এই বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান ভেঙ্গে পড়েছে। গেলো কয়েক বছর ধরে জেএসসি ও এসএসসি ফলাফল বিপর্যয় ঘটছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অত্র বিদ্যালয়ের এসএসসিতে ২০১৭ সালে পাশের হার ৩২.৩৫ ও ২০২০ সালে মাত্র ৪৪.৮৭।
বিদ্যালয়টির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বোর্ড নির্ধারিত ফি-এর অতিরিক্ত টাকা আদায় ও বিভিন্ন অজুহাতে স্কুলের তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। রীতিমত পুকুর চুরির ঘটনা বেড়িয়ে আসছে বোর্ডের তদন্তে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে কথিত ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রশিদুল হক খান ও প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত করেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। গত সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) মতলব উত্তর উপজেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল কাইয়ুম খান বোর্ডের নির্দেশে তদন্তে জন্য সরোজমিনে বিদ্যালয়ে আসেন। এসময় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হাতেনাতে ধরা পরে তদন্ত টীমের কাছে। তদন্তটীম সরোজমিনে বিদ্যালয়ের রেজুলেশন খাতা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান,গত ১জানুয়ারী ০১/০১/২০২০খ্রিঃ অধিবেশনে ৬০নং সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ৬০নং সভায় ৪নং এজেন্ডা ছিল, বিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরি করন প্রসঙ্গে। সভায় বিদ্যালয়ের জন্য ১টি খাট, ২টি আলমারি ও ২০জোড়া বেঞ্চ ক্রয়ের অনুমোদন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে সেসব আসবাব পত্র ক্রয় না করে ১৮/০১/২০২০ খ্রিঃ পরবর্তী ৬১নং সভায় ৬০নং রেজুলেশনের (৪নং এজেন্ডা) উক্ত আসবাবপত্র ক্রয় দেখানো হয়।
তদন্ত টীম সরোজমিনে প্রধান শিক্ষকের কাছে উক্ত আসবাবপত্র দেখতে চাইলে, প্রধান শিক্ষক শতশত মানুষের সামনে তা দেখাতে ব্যর্থ হন।
এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর উক্ত বিদ্যালয়ের সাবেক ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ফজলুল হক শিকদার মানিক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আক্তার হোসেন সরকার ও অলি উল্লাহ খান এলাকাবাসী ও অত্র বিদ্যালয়ের সাবেক ছাতত্র-ছাত্রী ফোরামের পক্ষ থেকে স্কুলের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে শিক্ষা সচিবের কাছে ৪পৃষ্টার একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
৪পৃষ্টার ঐ অভিযোগ পত্রে, নির্বাচন না দিয়ে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কাউকে না জানিয়ে রাতের আধারে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়, বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ভুয়া ভাউচারে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ, নিয়োগ বণিজ্যে ও স্কুলের টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক একাউন্টে জমা না দিয়ে ব্যাক্তিগত সংরক্ষনে রেখে আত্মসাৎ সহ এমন ২৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় ৪পৃষ্টার গুরুতর এই অভিযোগটি আমলে নিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে সরোজমিনে তদন্ত করে মতামত ও সুপারিশ প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলেন।
উক্ত চিঠির প্রেক্ষিতে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ১৬সেপ্টেম্বর মতলব উত্তর উপজেলা মাধ্যমিক অফিসারকে বিষয়টি অতীব জরুরী উল্লেখ করে ৭কর্মদিবসের মধ্যে তদন্তপূর্বক সুষ্পষ্ট মতামতসহ প্রতিবেদন বোর্ডে প্রেরণের কথা বলেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ২০০৯ সালের গেজেটের অনুচ্ছেদ ১১-এর (খ) অনুযায়ী, “সদস্য হইবার বা থাকিবার ক্ষেত্রে অযোগ্যতা, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারান কিংবা কোন বিদেশী নাগরিকত্ব গ্রহন করেন”।
অথচ দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে বিদ্যালয়ের সভাপতি পদ আকরে রাখা রশিদুল হক খান অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নিয়ে বহু বছর ধরে সেখানে বসবাস করছেন। ৩/৪ বছর পরপর দেশে আসলেও বিদ্যালয়ে না গিয়ে ঢাকায় থেকে স্কুলের কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করে চলে যান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে প্রধান শিক্ষক দিয়ে দেন বলে অভিযোগ আছে। তাই তদন্তের দিন স্থানীয় শতাধিক বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী তদন্ত টীমের কাছে প্রশ্ন করেন, “একজন অন্যদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া ও দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসরত ব্যক্তি সভাপতি পদে কীভাবে বহাল থাকেন?”
আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে, কোন সদস্য ৬মাসের বেশি বিদেশে অবস্থান, অন্যকোন দেশে নাগরিক্তকত্ব গ্রহন ও পরপর ৩টি সভায় অনুপুস্থিত থাকলে তার সদস্য পদ হারাবে। অথচ কথিত সভাপতি রশিদুল হক খানের বিরেুদ্ধে এই ৩টি অভিযোগই প্রমাণিত। সভাপতি রশিদুল হক খান, অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণসহ তার বিরুদ্ধে আনা ৩টি অভিযোগই টেলিফোনে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে স্বীকার করেছেন।
এলাকাবাসী জানান, সভাপতি রশিদুল হক খানের স্বেচ্ছাচারিতা ও অবহেলার কারণে মরহুম আকবর আলী খান সাহেবের গড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ৩৪টি কারিগরি কলেজ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যে কোন সময় এই প্রতিষ্ঠানটিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে, সভাপতি রশিদুল হক খান দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশে বসবাস করলেও তার স্বাক্ষর জাল করে বিদ্যালয়ে নিয়োগ, ভাউচারসহ সবকিছেই করেছেন প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামান। সভাপতি বিদেশে আছেন, এমন তথ্য গোপন করে গত ১ফেব্রয়ারী প্রধান শিক্ষক তার আপন খালাতো ভাই সুজনকে অত্যান্ত গোপনীয়ভাবে নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ দেন।
তদন্তে দেখা যায়, এবছরের ২৮জানুয়ারী অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে নৈশপ্রহরী পদে কথিত পরিক্ষা নেয়া হয়। উক্ত নিয়োগ পরিক্ষায় সুজন, কামরুল ইসলাম, সাঈদ আনোয়ার ও শিমুল নামের প্রধান শিক্ষকের নিকট আত্মীয় শুধু এই চারজন অংশ নেন।
৪জনের বাড়িই বিদ্যালয় থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরের পথ প্রধান শিক্ষকের নিজ এলাকা মতলব উত্তর উপজেলার মান্দারতলী গ্রামে। অনুসন্ধা দেখা যায়, যে ৪জন নৈশপহরী পদে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামানের ২জন খালাতো ভাই, একজন বিয়াই ও অন্যজন স্থানীয় লুদুয়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ছেলে তার মামাতো ভাই।
এদিকে একদিন পর ১ ফেব্রয়ারী প্রধান শিক্ষক তার খালাতো ভাই সুজন কে নৈশপ্রহরী পদে সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে নিয়োগ দেন। নিয়োগপ্রাপ্ত সুজন ছাড়া এই পরিক্ষায় অংশ নেয়া বাকি ৩জনই ছিলেন সাজানো ড্যামি প্রার্থী। রীতি অনুযায়ী নৈশপ্রহরী বিদ্যালয়রে কাছাকাছি গ্রাম থেকে নেয়ার নজির থাকলেও এই ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক স্কুলের আশপাশের এলাকার নৈশপ্রহরী পদে যোগদানইচ্ছুক অসংখ্য প্রার্থীর কাগজ-পত্র জমাই নেননি। প্রার্থীইচ্ছুকদের বলা হয়েছে ”নৈশপ্রহরী নিয়োগ হয়ে গেছে।”
বিদ্যালয়ের আশপাশে নৈশপ্রহরী পদে স্থানীয় অনেক প্রার্থী থাকা সত্বেও স্কুল থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরের পথ ভিন্ন ইউনিয়নের একজনকে এই পদে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়ার প্রতিবাদ করলে, শিক্ষকদের সাথে প্রধান শিক্ষক খারাপ আচরণ করেন।
এ ব্যাপারে অত্র বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হান্নান ও গনিত শিক্ষক তহিদুল ইসলাম খান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলে প্রধান শিক্ষক মো. নুরুজ্জামান এই মর্মে হুমকি দেন যে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কেউ বাঁধা দিলে, নৈশপ্রহরীর পরিবর্তে শিক্ষকদের দিয়ে স্কুলের ঘণ্টি বাজানো হবে।”
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছর ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বোর্ড কর্তৃক রেজিঃ ফি জনপ্রতি ৭৯টাকা নির্ধারণ করা হলেও প্রধান শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে ৫৫০টাকা করে আদায় করেন । একই ভাবে ৯ম শ্রেণির রেজিঃ ফি বোর্ড নির্ধারিত ১৬৮টাকার পরিবর্তে জনপ্রতি ৫৫০টাকা করে আদায় করেছেন। বিনা রশিদে আদায়কৃত এসব টাকা ব্যাংকে জমা না করে প্রধান শিক্ষক তার সংরক্ষণে রেখে আত্মসাতের চেষ্টা করেন।
এছাড়াও এসএসসি ও জেএসসি সনদ, নম্বরপত্র ও প্রত্যয়ন পত্র সরবরাহ করার সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিনা রশিদে পাঁচশো টাকা করে নেওয়া হয়। উক্ত টাকা স্কুলের একাউন্টে জমা করা হয় না। শিক্ষা বোর্ডের তদন্তে এসব অনিয়ম ধরা পড়ে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক তার অনৈতিক কর্মকান্ড বাস্তবায়নের জন্য স্কুলে তার পক্ষে সবসময় একটি শক্তিশালী বলয় তৈরী করে রেখেছেন। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন শিক্ষক কথা বললে, তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তার রোশানলে পড়ে তুচ্ছ কারনে মেধাবী অনেক খন্ডকালিন ও নিয়মিত শিক্ষক অত্র বিদ্যালয় থেকে বিতারিত হয়েছেন। খন্ডকালিন শিক্ষক হালিম, ইংরেজী শিক্ষক মেহেদী হাসান রনি, ও হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক সাইদুর রহমানকে তুচ্ছ কারণে স্কুল থেকে বিতারিত করেছেন সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক।
এদিকে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতি ও অনিয়ম ধামাচাপা দিতে একটি গ্রুপ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তদন্ত কর্মকর্তার সাথে চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগকারীরা দাবী করেছেন।
এব্যাপারে প্রধান শিক্ষক নুরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সত্য নয়।
বোর্ড কতৃক দায়িত্ব পাওয়া তদন্ত কর্মকর্তা মতলব উত্তর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষ অফিসার, আবদুল কাইয়ুম খান বলেন, বেশ কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে, তদন্তে আরও কিছু সময় লাগবে।