করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পর আগামী রবিবার সব সরকারি-বেসরকারি অফিস এবং সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এসংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমিত পরিসরে লকডাউন তুলে দেওয়ার মাধ্যমে সরকার ১৫ দিনের পরীক্ষামূলক সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর নতুন সিদ্ধান্ত আসবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। করোনা সংক্রমণের পরও জীবিকার প্রয়োজনে তথা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সরকারের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১ জুন থেকে বিমানের অভ্যন্তরীণ তিনটি রুটে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজও চলবে। বাংলাদেশ রেলওয়ে রবিবার থেকে সীমিত পরিসরে আন্ত নগর ট্রেন পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সীমিত আকারে বাসসহ অন্যান্য গণপরিবহন চালু করা হবে একই দিন থেকে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কর্মজীবী মানুষেরা সরকারের এ উদ্যোগে খুশি। তাঁরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টির প্রতি কঠোরভাবে তদারকি বাড়াতে হবে। কারণ রাজধানীতে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি। এ মহানগরীতে সামাজিক দূরত্ব মানাই বড় চ্যালেঞ্জ। পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সব কিছু খুলে দিতেই হচ্ছে। এ অবস্থায় গণপরিবহনে ঝুঁকি বেশি থাকবে। এ ঝুঁকি কমাতে সরকারকে বিশেষ গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। একটি বাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হলে মালিকরা যাত্রী পাবেন অর্ধেক। তাঁদের আয় কমে যাবে। এ ছাড়া গাড়ি জীবাণুনাশক দিয়ে ধুতেও খরচ বাড়বে। এ খরচ বাড়া আর আয় কমে গেলে সরকার কি ভর্তুকি দেবে? সরকার যদি ভর্তুকি না দেয় তাহলে মালিকরা লোকসান দিয়ে কি বাস নামাবেন? রাজধানীতে তাই গণপরিবহন পরিচালনায় পরীক্ষামূলকভাবে কিছু রুট বেছে নিয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কারণ সাধারণ সময়েই বাস মালিক ও চালকরা আয়ের জন্য বেশি যাত্রী পরিবহন করে অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রে কঠোর তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণকালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর অংশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। কানাডায় লকডাউন তুলে দেওয়া হয়েছে। দেশটির কুইবেক প্রদেশের বাসিন্দা, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী শিল্পী হালদার জানান, ১১ মে থেকে কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। মাস্ক পরে কর্মস্থলে যাচ্ছি। যে বাসে চলাচল করতে হচ্ছে তাতে যাত্রী সীমিত।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারের বাসিন্দা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী খায়রুল ইসলাম রোজেন বলেন, সবাই নয় তবে বেশির ভাগ লোকজন এখানে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন। কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই তাঁরা বাসে চড়ছেন। প্রবীণদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। লন্ডনে মাস্ক ব্যবহার বাড়েনি। তবে সামাজিক দূরত্ব প্রায় সবাই মানছেন, যা ঢাকা মহানগরীতে ভাবা যায় না।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের গণপরিবহন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চালুর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশের গণপরিবহন মালিক- চালকদের দিয়ে আইন মানানো কঠিন চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে আয় না থাকায় পরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। ফলে তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাই এখন মুখ্য বিষয়। তাঁদের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে গণপরিবহন পরিচালনা করা কতটুকু সম্ভব, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অন্য দিকে সড়কে যারা চাঁদাবাজি করে তারাও সক্রিয় হয়ে উঠবে। এমন অবস্থায় সরকার আরোপিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দিলে সড়কে শৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করা সম্ভব।’
চলমান সাধারণ ছুটি শেষ হচ্ছে আগামীকাল শনিবার। রবিবার থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু পরিচালনা করতে হবে। একই সঙ্গে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন তথা বাস, লঞ্চ ও ট্রেনও চালু হবে রবিবার থেকে। ‘স্বাস্থ্যবিধি’ ও ‘সীমিত পরিসর’ মেনে কিভাবে চলতে হবে, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে বলে জানা গেছে। বিমান কর্তৃপক্ষ নিজ ব্যবস্থাপনায় বিমান চলাচলের বিষয়ে বিবেচনা করবে। ব্যাংকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। পুঁজিবাজারও খুলছে রবিবার। নিষেধাজ্ঞাকালীন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাবে না। তবে অনলাইন কোর্স বা ডিসট্যান্স লার্নিং অব্যাহত থাকবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সরকারি- বেসরকারি অফিসগুলো নিজ ব্যবস্থাপনায় সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও অসুস্থ কর্মচারী, সন্তানসম্ভাবনা নারীরা কর্মস্থলে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জারি করা ১৩ দফা নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া জরুরি অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র ছাড়া সব বৈঠক ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে আয়োজন করতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস আদেশ জারি করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ছুটিসংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব শেখ ইউসুফ হারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা অফিস আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছি। নির্ধারিত সময়- পরবর্তী পদক্ষেপের কথা জানতে পারবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, লকডাউন খুলে না দিয়ে উপায় নেই। তাই প্রাথমিকভাবে ১৫ দিনের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কদিনে কী অবস্থা দাঁড়ায় তা দেখে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ থেকে টানা ৩০ মে পর্যন্ত (কয়েক দফা বাড়িয়ে) সাধারণ ছুটিতে রয়েছে দেশ। তবে জরুরি পরিষেবাসংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ ছুটির আওতার বাইরে রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা : ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে। ৫, ৬, ১২ ও ১৩ জুনের সাপ্তাহিক ছুটি এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থাৎ ছুটির দিনগুলোতেও সীমিত পরিসর এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নিষেধাজ্ঞাকালে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় জনসাধারণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। প্রতিটি জেলার প্রবেশ ও বহির্গমন পথে চেকপোস্টের ব্যবস্থা থাকবে। রাত ৮টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (প্রয়োজনীয় ক্রয়-বিক্রয়, কর্মস্থলে যাতায়াত, ওষুধ ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে আসা যাবে না। তবে সর্বাবস্থায় বাইরে চলাচলের সময় মাস্ক পরিধানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অন্যথায় নির্দেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নিষেধাজ্ঞাকালীন জনসাধারণ ও সব কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জারি করা নির্দেশমালা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। হাট-বাজার, দোকানপাটে ক্রয়-বিক্রয়কালে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। শপিং মলের প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। শপিং মলে আসা যানবাহনগুলোকে অবশ্যই জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাট-বাজার, দোকানপাট এবং শপিং মলগুলো অবশ্যই বিকেল ৪টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কাজে নিয়োজিত সংস্থা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন—ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাকসেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে।
গণপরিবহন পরিচালনার বিষয়ে আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বিকেলে বৈঠক করবে। তাতে অংশীজনরা উপস্থিত থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়েও সীমিত আকারে ট্রেন চালাতে আগামীকাল শনিবার বৈঠকে বসছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান।
অনেক জেলায় সীমিত আকারে দোকানপাট খোলা না রেখে ব্যাপকভাবে খোলা রাখা হচ্ছে। ফলে সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিনসহ সমিতির নেতারা এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে জরিমানা আদায়ের দাবি জানিয়েছেন।