স্টাপ রিপোর্টার ঃ
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ সর্বসম্মত হয়ে এই আদেশ দেন। তবে খালেদা জিয়া যদি সম্মতি দেন তাহলে মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সর্বোচ্চ আদালতের এই আদেশের ফলে হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তির আর কোনো সুযোগ থাকছে না বলে মনে করেন শীর্ষ আইনজীবীরা।
আদালতে গতকাল খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনের ওপর এবং তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও জয়নুল আবেদীন। শুনানিতে জয়নুল আবেদিন বলেন, আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা মানবিক কারণে খালেদা জিয়ার জামিন চাইছি। খালেদা জিয়া সুস্থ মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দরকার। এ জন্য মানবিক দিক বিবেচনা করে তার জামিন আবেদন করেছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে বলেন, এক মামলায় খালেদা জিয়ার ১০ বছরের সাজা হয়েছে। অন্য মামলায় সাত বছর সাজা হয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আবেদনে বলেছেন- ১৯৯৭ সালে একবার ও ২০০২ সালে একবার হাঁটু প্রতিস্থাপন করেছেন তিনি। তাহলে তো ন্যাচারালি তার হাঁটা রেস্টিকটেড হবে। এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় যেমন দ্রুত আপিল শুনানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটাতেও দিতে পারেন।
খুরশীদ আলম খান বলেন, আপিল বিভাগে জামিন আবেদন খারিজ করায় এই মামলায় হাইকোর্টের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তির কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু আপিল বিভাগ সর্বসম্মত হয়ে এই রায় দিয়েছেন; সেই কারণে রিভিউয়ের সুযোগ থাকলেও জামিনের সুযোগ একেবারেই কম। তিনি বলেন, আবেদনকারীর পক্ষে কয়েকটি মামলার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের হচ্ছে অবৈধ সম্পত্তির মামলা। আর এটা হলো ক্ষমতার অপব্যবহারের। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে চ্যারিটির নামে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। হাইকোর্ট অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে জামিন দেননি। তিনি আরো বলেন, মেডিকেল বোর্ড যদি খালেদার সম্মতি না পান তাহলে চিকিৎসায় বোর্ড আর ডাক্তারের কী করার আছে? তিনি তো সহযোগিতা করছেন না। এটাতে তার একটা সমস্যা আছে। ডাক্তাররা তাকে সময়ে সময়ে সব কিছু অবহিত করছেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মতি দিচ্ছেন না। সব দিক বিবেচনা করে তার জামিন আবেদন খারিজের আর্জি জানান খুরশীদ আলম খান।
এর আগে সকাল সোয়া ১০ টায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চে আপিল শুনানি শুরু হয়। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মেডিকেল বোর্ডের পাঠানো প্রতিবেদন আদালতের কাছে পেশ করেন।
এর আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাত বছরের সাজার রায়ের পর হাইকোর্টে জামিন চেয়েছিলেন তার আইনজীবীরা। অপরাধের গুরুত্ব, সংশ্লিষ্ট আইনের সর্বোচ্চ সাজা এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদাসহ অন্য আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত- এ তিন বিবেচনায় হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৩১ জুলাই আবেদনটি খারিজ করে দিলে খালেদার আইনজীবীরা আপিল বিভাগে আসেন।
আদেশের পর খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, জামিন চেয়ে আমরা আইনি লড়াই চালিয়েছি। সাত বছরের সাজায় জামিন না দেয়া নজিরবিহীন। এটি সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হয়ে থাকবে। আমরা একজন অসুস্থ মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের সহমর্মিতা কামনা করেছিলাম। কিন্তু সেই বিষয়গুলো কোনোভাবেই বিবেচনায় নেয়া হলো না। পৃথিবীতে এমন রায়ের নজির আমরা কখনো দেখিনি।
এদিকে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি চলার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে পরস্পরবিরোধী বিক্ষোভ করছেন বিএনপি ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন থেকে সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশের লবিতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা-পাল্টি চেলোগান দেন তারা।
হাইকোর্ট এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিলে গত ১৪ নভেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৮ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া আগে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানতে মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন চায়। গত ৫ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা প্রতিবেদন দিতে না পারায় এজলাসে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে তাদের আরো ছয় দিন সময় দিয়ে ১২ ডিসেম্বর আদেশের দিন ঠিক করে আদালত। সেদিনের হট্টগোলের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আদালত কক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা।
এদিকে খালেদার আপিল শুনানি ঘিরে বিএনপি অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে এমন আশঙ্কায় সকাল থেকেই নগরীতে সতর্ক অবস্থান নেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অসংখ্য নেতাকর্মী এসে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়। বিভিন্ন পাড়া মহল্লায়ও সতর্ক ছিল তাদের সতর্ক অবস্থান। অন্যদিকে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পর রাজধানীর কিছু কিছু স্থানে বিএনপির অল্পকিছু নেতাকর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে সফল হননি তারা।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের সাত নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি) জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হ