|| ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১৮ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২রা শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
খুলনার দাকোপের বাজুয়া গণহত্যা
প্রকাশের তারিখঃ ২৬ মার্চ, ২০২৪
মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন আজ। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পাক-হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। ২৫শে মার্চ, গণহত্যা দিবস আজ।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ ছিল বাঙালির একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক নারকীয় পরিকল্পনা। সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না’। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত্রি। এক ভয়াল ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত এই রাত দেশের দক্ষিণের জেলা খুলনার একটি ছোট উপজেলা দাকোপ। এ উপজেলার অনেকটা অংশজুড়ে নদী আর সুন্দরবন। উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়নে এই সময়ে ঘটে ভয়াবহ গণহত্যা। এখানে অসংখ্য মানুষ ভারতে রওনা হওয়ার জন্য এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকার ইচ্ছে তাদের ছিল; এসে তা হতে পারেনি সেদিনÑ কয়েকশ’ পরিবারকে ওরা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল মুহূর্তে। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বীর শরণার্থী দল ছিল সেটি। সেই বহর নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল পাক মিলিটারি ও রাজাকাররা। একজন শিশু কিংবা একজন মা-ও রেহাই পায়নি সেদিন। এমন মানুষ হত্যার ভয়াবহ ঘটনা যে স্থানে ঘটেছিল সেই বাজুয়ায় সেখানে ছিল একটি বাজার আর স্কুল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে হাট বসতো। মোংলার খুব কাছে হওয়ায় বাজুয়া বাজারে তখন মানুষের সুবিধা হতো, কেননা যুদ্ধকালে কোথাও নিরাপদ ছিল না কারও জন্য।
নির্মম এ ঘটনাটি ঘটেছিল ৬ মে ১৯৭১। পাকবাহিনীরা এপ্রিল মাসের শেষে বাগেরহাট থানায় হামলা শুরু করে। এ কারণে বাগেরহাট, রামপাল, মোরেলগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ নিজ বাড়ি থেকে রওনা হয়ে যায়। সবাই সীমান্ত পার হওয়ার দু-একদিন আগে থেকে বাজুয়ায় জড়ো হতে থাকে। সবার উদ্দেশ্য ছিল একসঙ্গে যাওয়া। এই অঞ্চল নদীতে ঘেরা। ফলে বাজুয়াকে নিরাপদ আশ্রয় ভেবেও এখানে অনেকে এসেছিলেন। মানুষের এমন দলে দলে আসার ফলে এলাকার চিত্র বদলে যায়, বাজুয়া স্কুলের সমস্ত এলাকা, বাজার আশপাশের বাড়ি সর্বত্র লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
সে সময়ে এ অঞ্চলে লঞ্চ-বোট কিংবা নৌকা ছাড়া চলাচলের কোনো উপায় ছিল না। এমন সময় নির্মমতম দিনটি আসে। দুটি লঞ্চে করে পাকিস্তানি বাহিনী নামে বাজুয়ার স্কুল ঘাটে। তাদের সঙ্গে ছিল কিছু মুখচেনা রাজাকার, আলবদর। বাজুয়া স্কুলটি ছিল একটি দ্বিতল ভবনসহ বেশ কয়েকটি ভবন। অসংখ্য পরিবার স্কুলের ভবনের প্রতিটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। ঘাতকরা এসেই পুরো স্কুল ঘিরে ফেলে। আর সেদিন ছিল বাজুয়ার হাটের দিন। এলাকাটির পুরোটাই তারা ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। মানুষ প্রাণভয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে আর গুলি খেয়ে পাখির মতো মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে রাস্তায়, মাঠে, হাটের দোকানের সামনে, বাড়ির দাওয়ায়, উঠোনে, স্কুলের বারান্দায় সবখানে। এই নির্বিচার গুলি থেকে বাঁচতে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ পাশ্ববর্তী গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। স্কুলের ভেতরে যারা ছিল তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। খুলনার মুক্তিযোদ্ধা জেমস টি সরকার লিখেছেন- ‘এ দিনে রামপাল, বাগেরহাট, পিরোজপুর থেকে হাজার হাজার হিন্দু নৌকায় করে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাজুয়ার হাট স্কুলে জড়ো হয়েছিল। এ খবর পেয়ে মিলিটারিরা এসে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। একই সময়ে এদেশীয় দোসররা শুরু করে লুটপাট, ধর্ষণ। সে এক ভয়ংকর অবস্থা। সত্যিকার অর্থে ‘মৃত্যুপুরি’তে পরিণত হয়েছিল বাজুয়া।
স্থানীয় অনেকের মতে, বেলা ৩টার দিকে পাকসেনারা বাজুয়া বাজারে এই আক্রমণটি চালায়। তারা গুলি করতে করতেই বাজারে নামে। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যারা ছুটে পালানোর চেষ্টা করেছিল তাদেরও মরতে হয়েছে মিলিটারির গুলিতে। পাকমিলিটারির হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা পড়ে পিপুলবুনিয়া গ্রামের হরিপদ মুখার্জী। তাকে পাকিস্তানিরা নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে সারা শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসরদের গণহত্যা করতে করতে যে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল এটিও তারই আরও একটি ঘৃণ্যতম উদাহরণ। আজও জানা যায় না গণহত্যায় সঠিক শহীদের সংখ্যা। তবে প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, এ সংখ্যা কোনোভাবেই ছয় শত জনের কম না। দেশের মানুষের কাছে- তরুণ প্রজন্মের কাছে এ ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। বিজয়ের প্রাক্কালে সেদিনের সব শহীদসহ মুক্তিযুদ্ধে আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাই
Copyright © 2025 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.