|| ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
জেনে নিন বর্তমান সময়ের দাম ও ১৯৭৪ সালের ১ টাকায় টাকা পেতেন আপনি,
প্রকাশের তারিখঃ ৫ জুলাই, ২০২৩
এক সময় দেশে জমিদারদের বিপুল প্রতাপ-প্রতিপত্তি ছিল। জমিদারের বাড়ির আশপাশ দিয়ে জুতো পায়ে হাঁটার সাধ্য ছিল না কারো। প্রখর রোদে কিংবা অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্যে জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া যেত না ছাতা মাথায় দিয়ে।
জমিদারের মুখের কথাই ছিল আইন।কিন্তু সেকালের কোনো জমিদার জীবনে যে পরিমাণ পয়সা দেখেছেন, একালের দুঃখী ভিখারির ঝুলিতেও থাকে তার চেয়ে বেশি। সে আমলে কয়েক থানা বা মহকুমা এলাকা ঘুরেও একজন কোটিপতির দেখা পাওয়া কঠিন ছিল। এখন পাড়া-মহল্লায় কোটিপতির ছড়াছড়ি, তবুও যেন অনেকটাই নিঃস্ব তারা।
চাইলেই কোনো কিছু পাওয়ার ক্ষমতা নেই তাদের। সেকালের পয়সার সঙ্গে একালের টাকার বড় অঙ্কের নোটগুলোর ক্রয় ক্ষমতার ব্যবধানই এখনকার কোটিপতিদের সঙ্গে সেকালের পয়সা ওয়ালাদের দূরত্ব নক্ষত্র সমান করে রেখেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ২০ টাকায় এক মণ চাল পাওয়া যেত, ১ পয়সায় মিলত চকোলেট। ১৯৭৪ সালে চালের দাম বেড়ে প্রতিমণ ৪০ টাকায় পৌঁছলে দেশজুড়ে হাহাকার শুরু হয়েছিল।
এর পরও ধনীর আদুরে দুলালেরা স্কুলে যাওয়ার সময় টিফিন বাবদ বড়জোর ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা করে পেত মা-বাবার কাছ থেকে।তা দিয়ে আইসক্রিম, চকোলেট, ঝালমুড়িসহ বেশ কয়েকটি আইটেম মিলত। গরিব শিশুরা এক পয়সাও পেত না কোনো কোনো দিন।
তখনকার মধ্যবিত্তরা পাঁচ পয়সা, ১০ পয়সা দিত বাচ্চাদের টিফিনের জন্য। এখনকার প্রজন্ম এসব কথা রূপকথা ভেবে উড়িয়ে দেয়। কেননা এখনকার ভিক্ষুকরাও দুই টাকার কম নিতে গড়িমসি করে। প্রতি কিলোমিটারে অন্তত দুবার যাত্রী ওঠানামা করায় এমন বাসগুলোর গায়েও মোটা হরফে লেখা থাকে ‘সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা’।
আর দূরত্ব আধা কিলোমিটার হলেও ১০ টাকার নিচে ভাড়া কাটার অভ্যাসই নেই কথিত সিটিং বাসগুলোর হেল্পারদের।বাংলাদেশে টাকার মান নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ। ১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার মান কতটা কমেছে তা জিডিপি ডিফ্লেটর ভিত্তিতে হিসাব করে অর্থবিভাগের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছরের এক টাকার ক্রয় ক্ষমতা ২০১৪ সালের ১২ টাকা ৪৫ পয়সার ক্রয় ক্ষমতার সমান।
অন্যভাবে বলা যায়, ২০১৪ সালের এক টাকার ক্রয়ক্ষমতা ১৯৭৪-৭৫ সালের ৮ পয়সার ক্রয়ক্ষমতার সমান। অর্থাৎ ১৯৭৪-৭৫ সালে এক টাকা দিয়ে যা কেনা যেত, এখন সেই পণ্যটিই কিনতে খরচ করতে হবে ১২ টাকা ৪৫ পয়সা। অথবা এখন যে পণ্যটি এক টাকায় পাওয়া যায় ১৯৭৪-৭৫ সালে তা কিনতে লাগত ৮ পয়সা।অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বার্ষিক গড়ে ৭.৩ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
এতে সহজেই অনুমান করা যায়, সময় প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি নোট ও কয়েনগুলোর (এক পয়সা থেকে দুই টাকা পর্যন্ত) ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঐতিহ্যের স্মারক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত মুদ্রাগুলো বাজার থেকে ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই গত জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, এক ও দুই টাকার নোট ও কয়েন থাকবে না। সর্বনিম্ন সরকারি মুদ্রা হবে পাঁচ টাকা। যদিও সমালোচনার মুখে ওই অবস্থান থেকে পরে সরে আসেন অর্থমন্ত্রী।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রফিকুল ইসলাম বলেন, অর্থবিভাগের হিসাবে টাকার মানের যে ক্ষয়চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবে ক্ষয় হয়েছে আরো বেশি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে ঢাকার সোবহানবাগ থেকে গুলিস্তানের বাসভাড়া ছিল ৫০ পয়সা।ওই সময় পাঁচ পয়সায় পাঁচটি হজমি কেনা যেত। পাঁচ পয়সায় মিলত একটি সাদামাটা আইসক্রিমও। গ্রামের বরফকলে তৈরি সর্বনিম্নমানের আইসক্রিমও এখন এক টাকার কমে জোটে না।
আর তখনকার হজমির চেয়ে এখনকার হজমির মান বেড়েছে, সঙ্গে দামও এক পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে এক টাকায়। ১৯৮৫ সালে ঢাকার সোবহানবাগ থেকে গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায় যেতে রফিকুল ইসলামের মোট খরচ হতো ১২ টাকা। সোবহানবাগ থেকে ৫০ পয়সায় গুলিস্তান যাওয়ার পর সেখান থেকে ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে বাসে যেতেন ঘোড়াশাল। পরে লঞ্চের দোতলায় সবচেয়ে বিলাসবহুল সিটে বসে দেড় টাকা ভাড়া দিয়ে পৌঁছতেন কাপাসিয়া।
এখন সেই কাপাসিয়া পর্যন্ত যেতে তাঁর আর লঞ্চে উঠতে হয় না, কিন্তু ভাড়া গুনতে হয় ১৭০ টাকার মতো।সেদিনের সেই ‘মূল্যবান’ পয়সার দাম দিন দিন কমে রূপকথার গল্পের যুগে ঠিকানা করে নিয়েছে। এক সময় যে পয়সার এত মূল্য ছিল, কালের পরিক্রমায় এখন তা দিয়ে কোনো পণ্য পাওয়া যায় না।
শুধু মোবাইলফোন কম্পানিগুলোর কাছ থেকে কথা বলার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় পাওয়া যায়। হালে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে ‘প্রতি সেকেন্ড ১ পয়সা’ জাতীয় সুযোগ দেওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে পয়সার মূল্য। তবে পয়সা বা এক টাকা-দুই টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমা নিয়ে চিন্তিত নয় সরকার। বরং এসব ব্যাংক নোটের তুলনায় সরকারি মুদ্রার অংশীদারি কমে যাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে অর্থ বিভাগ।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, দুই টাকার কয়েন বা দুই টাকার নোট পর্যন্ত সরকারি মুদ্রা। পাঁচ টাকার নোট ও কয়েন থেকে ১০০০ টাকার নোট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের। স্বাধীনতার পর মুদ্রাবাজারে মোট টাকার মধ্যে সরকারি মুদ্রার যে অংশ ছিল, দিন দিন তা অনেক কমে গেছে। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বছরওয়ারি ও মাসওয়ারি দেশের অর্থের সরবরাহ, মোট সরবরাহ থাকা অর্থের মধ্যে সরকারি মুদ্রার হার, ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশের বাজারে প্রচলিত অর্থের মোট পরিমাণ ছিল ৩১৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ৩০৬ গুণ বেড়ে হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট ও কয়েন ৩৪০ গুণ বেড়ে হয়েছে ৯৬ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। কিন্তু এ তুলনায় সরকারি নোট ও কয়েন বাড়েনি। ১৯৭৪-৭৫ সালে বাজারে প্রচলিত নোট ও কয়েনের মধ্যে সরকারি মুদ্রার মূল্যমান ছিল ৩৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা ২৩ গুণের মতো বেড়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ ৭৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। আর ১৯৭৪-৭৫ সালে জিডিপির তুলনায় সরকারি মুদ্রার হার ছিল দশমিক ২৭ শতাংশ,
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.