|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান- ড.সরকার আবদুল মান্নান
প্রকাশের তারিখঃ ২৮ জুন, ২০২৩
প্রবন্ধ:- খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান
লেখক:-ড.সরকার আবদুল মান্নান
বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে যে আনন্দ, অফুরন্ত উচ্ছ্বাস, সাত্ত্বিকতাবোধ, ঐক্যচেতনা ও নতুন করে কর্মযজ্ঞ শুরু করার প্রেরণা লাভ করা যায়, তার কোনো তুলনা হয় না। ঈদের দিনগুলোতে আমাদের জীবনে এক ধরনের মুক্তির আস্বাদ নিয়ে আসে। প্রাত্যহিক কর্মের ছকবাঁধা জীবন থেকে আমরা মুক্তি পাই এবং মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানোর ফুরসৎ লাভ করি। যে নারীগণ প্রতিনিয়ত পারিবারিক কাজে উদয়াস্ত নিয়োজিত থাকেন, তারাও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিবিড় সান্নিধ্যে উৎসবের আনন্দ উপভোগ করেন। এও এক ধরনের মুক্তি। এভাবে ঈদ মানেই হলো আনন্দ, ঈদ মানে মুক্তি, ঈদ মানে ঐক্য, ঈদ মানে শুদ্ধি।
আরব ভূমিতে ৬২৬ সালে প্রথম ঈদ উৎসব প্রবর্তিত হয়। কিন্তু ভারতবর্ষে ঈদের ইতিহাস বেশিদিন আগের নয়। বারো শ শতকের পর থেকে এখানে ঈদ অনুষ্ঠান শুরু হলেও গত দেড়শ-দুশ বছর আগেও বাংলাদেশে ঈদ কোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল না। ঢাকায় মুঘলদের আগমন ঘটে ১৬১০ সালে। আর এখান থেকেই শুরু হয় ঈদ অনুষ্ঠান। আকাশে ঈদের চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকে ঢাকায় শুরু হতো তূর্যধ্বনি আর আতশবাজি ফোটানোর উৎসব। মধ্যরাত পর্যন্ত চলত এই উৎসব। ভোর রাতে কামানের গোলা দাগিয়ে এই উৎসবের পরিসমাপ্তি টানা হতো। সে সময় যেভাবে ঈদ উদযাপিত হতো তা আজকের মতো ছিল না। মুঘলদের কাছে ঈদের অনুষ্ঠানটি ছিল পরিচ্ছন্ন বিনোদন। সে সময় ঈদ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হতো সংগীতের, নৃত্যের ও বাদ্যবাধনের। দুই-তিন দিন পর্যন্ত মুঘল পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন মিলে এই ঈদ উৎসবে বিভোর হয়ে থাকতেন। মুগলদের এই ঈদ-অনুষ্ঠানে সাধারণ লোকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ঈদের দিন তারা একসঙ্গে নামাজ পড়তেন। নামাজ পড়ে ফেরার পথে হাতি বা ঘোড়ার পিঠ থেকে তারা সাধারণ মানুষের দিকে পয়সা ছুরে দিতেন।
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার শাসক হিসেবে পাঠান ১৬৩৯ সালে। শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪০ সালে বর্তমান ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোডে ঈদগাহ নির্মিত হয়েছিল। ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মুসলমানরা এই ঈদগাহে নামাজ পড়তেন। এই ঈদগাহটিতেও তখন সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। ক্রমে ক্রমে ঈদের উৎসব মুঘল পরিবারের গণ্ডিছাড়িয়ে বাইরে চলে আসে এবং একসময় বাংলাদেশের গ্রামে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এবং বহু বছর ঈদকে কেন্দ্র করে গান, নাচ ও বাদ্যবাধনের রেওয়াজ ছিল। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “সাধ্যমতো নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান-বাজনা করিত। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায় বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।”
কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজি শরীয়তুল্লাহর সময় থেকে বঙ্গে উৎসব করে ঈদ উদযাপনের প্রচলন শুরু হয়। তার আগে এখানে প্রচুর মুসলমানের বসবাস থাকলেও সনাতন ধর্মের লোকায়ত সংস্কৃতির বাইরে তেমন কোনো সংস্কৃতি ও উৎসবের প্রচলন ছিল না। এমনকি কারো কারো মতে দেশ বিভাগের পূর্বেও বাঙালি জীবনে ঈদ তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব হয়ে ওঠেনি। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না এবং ঈদ উদযাপনের বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হতো না। বিশেষ করে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা একাধিকজনে মিলে গরু কোরবানি দিয়ে ঈদ উদযাপনের যে সামর্থ্য এখন মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তার লেশমাত্রও ছিল না চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে। সামান্য কিছু নতুন কাপড়চোপড় ও মিষ্টান্নের আয়োজন করে তখন ঈদ উৎসব উদযাপন করা হতো। তবে পারস্পরিক সম্পর্কের হার্দিকতা ছিল বিস্ময়কর এবং ঈদের দিনে শিশু-কিশোরদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। অনেক স্থানে শুরু হতো মেলা। শিশুদের বাঁশি বাজানোর সুরে গ্রামীণ জীবন মুখর হয়ে উঠত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে ঈদ উৎসব এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে।
দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে' লিখেছিলেন, “মুসলমানগণ ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান হইতে আসুন না কেন, এদেশে আশিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙালি হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দু প্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল, মহররম, ঈদ, শবেবরাত প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল।” এই জাতিগত ও ধর্মগত সংস্কৃতির মেলবন্ধনের ভেতর দিয়ে হয়তো শুরু হয়েছিল আমাদের ঈদ উৎসবের ক্ষীণ ধারার যাত্রারম্ভ। কিন্তু সেই যাত্রারম্ভের কোনো ইতিহাস মধ্যযুগের সাহিত্যে মুদ্রিত হয়নি। মধ্যযুগে মুসলমানদের বিপুল সাহিত্যভাণ্ডারের কোথাও ঈদের কথা নেই, ঈদ-উৎসবের উল্লেখ নেই। সে সময় মুসলিম কবিদের রচিত সাহিত্যে রোমান্স, কল্পকথা, ইসলামী পুরাণ, লোকপুরাণ, ইসলামের ইতিহাস, আরবি-ফারসি-হিন্দি কাব্যগ্রন্থের তর্জমা বা ভাবানুবাদ মুখ্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু লোকজীবন, লোকাচার, ধর্মাচার অর্থাৎ বাঙালি-মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনাচরণ ও জীবনাকাঙ্ক্ষা তাদের লেখায় ফুটে ওঠেনি। ফলে অনিবার্যভাবেই সে সময় ঈদ উদযাপিত হতো কি না এবং হলে কীভাবে হতো তার কোনো নিদর্শন মধ্যযুগের সাহিত্যে পাওয়া যায় না।
আধুনিক যুগে এসে মানুষর ব্যক্তিজীবন, প্রাত্যহিক জীবন ও জনজীবনের আখ্যান নিয়ে সাহিত্যের যে নতুন ধারা শুরু হয়, সেখান থেকেই ঈদ হয়ে ওঠে সাহিত্যের উপকরণ। আর যাদে হাত ধরে ইসলাম ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঈদ এবং ঈদের তাৎপর্য ও আনন্দধারা শত উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে ওঠে, তারা হলেন কায়কোবাদ, মোজাম্মেল হক, রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, মওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী, সৈয়দ এমদাদ আলী, শেখ ফজলুল করিম, শাহাদাৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, কাজী আবদুল ওদুদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং সর্বোপরি কাজী নজরুল ইসলাম।
আবদুল মান্নান সৈয়দ জানিয়েছেন যে, সৈয়দ এমদাদ আলীর কবিতাগ্রন্থ ডালির দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ঈদ’ নামে দুটি কবিতা আছে। প্রথমটির প্রথম ছত্র ‘কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে’ এবং দ্বিতীয়টির প্রথম ছত্র ‘বিশ্বজুড়ে মুসলিমের গৃহে গৃহে আজি’। প্রথম কবিতাটি ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বর্ষ নবনূর-এর ঈদÑসংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি ঈদ বিষয়ে প্রথম কবিতা। কবিতাটি দুটি স্তবক এরকম : “কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে/ তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে/ রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে/ আজ কি হর্ষ ভরে।/ আজি প্রভাতের মৃদুল বায়/ রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়/ মুসলিম জাহান আজি একতায়/ দেখ কত বল ধরে?”
আজকের দিনে অনেক পত্রিকার ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার এই ঈদ-সংখ্যাগুলের জন্য একসময় পাঠকগণ অপেক্ষায় থাকতেন। আর এই ঈদ-সংখ্যার ধারণা যিনি প্রথম নিয়ে আসেন তিনি সৈয়দ এমদাদ আলী। সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে। এ বছরই পত্রিকাটির ঈদ-সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এবং একইভাবে ১৯০৪ ও ১৯০৫ সালেও পত্রিকাটির ঈদ-সংখ্যা প্রকাশ করে। এই সংখ্যায় কবিতা ও গদ্য লিখেন সৈয়দ এমদাদ আলী, কায়কোবাদ ও মিসেস আর. এস হোসেন অর্থাৎ রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। নবনূর-এর পৌষ ১৩১১ সংখ্যায় কায়কোবাদ লেখেন ‘ঈদ’ শীর্ষক কবিতা। বিখ্যাত ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত নবনূর-এর ফাল্গুন ১৩১১ সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘ঈদজ্জোহা’ নামক প্রবন্ধ। নবনূরÑএর পৌষ ১৩১২ সংখ্যায় একই সঙ্গে ঈদ-সম্পর্কিত তিনটি লেখা প্রকাশিত হয়। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতা, জীবেন্দু কুমার দত্তের ‘ঈদ সম্মিলন’ কবিতা এবং মিসেস আর এস হোসেনর ‘ঈদ সম্মিলন’ প্রবন্ধ। রোকেয়া তাঁর প্রবন্ধে লিখেন, “এমন শুভদিনে আমরা আমাদের হিন্দু ভ্রাতৃবৃন্দকে ভুলিয়া থাকি কেন? ঈদের দিন হিন্দু ভাতৃগণ আমাদের সহিত সম্মিলিত হইবেন, এরূপ আশা কি দুরাশা? সমুদয় বঙ্গবাসী একই বঙ্গের সন্তান নহেন কী? অন্ধকার অমানিশার অবসানে যেমন তরুণ অরুণ আইসে, তদ্রুপ আমাদের এখানে অভিশাপের পর এমন আশীর্বাদ আসুক, ভ্রাতৃবিরোধের স্থানে এখন পবিত্র একথা বিদ্যমান থাকুক। আমিন!”
‘ঈদ আবাহন’ নামে কায়কোবাদ দুটি কবিতা লিখেছেন। একটি অশ্রুমালা কাব্যগ্রন্থে এবং অন্যটি অমিয়ধারা কাব্যগ্রন্থে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। “আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মনঃপ্রাণ,/ জাগায়ে মোশ্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান।/ ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিস্মান রবি,/ জীবন সার্থক হবে, ধন্য হইবে এ দরিদ্র কবি।”
কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা বিবেচনা করে মীর মশাররফ হোসেন গরু কোরবানি দেওয়ার বিরোধিতা করেন। আর সেন্ট্রাল খেলাফত কমিটি গো-কোরবানির বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন জারি করে। এই পটভূমিতে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এসলামাবাদী ‘ঈদুল আজহা’ প্রবন্ধে কোরবানির প্রসঙ্গে কয়েকটি যুক্তি প্রদান করেন। তিনি লিখেছেন, “কোরবানির দ্বারা একেক দীনদরিদ্র লোকেরা প্রীতিকর ও তৃপ্তিকর ভোজ পায়, পশুচর্ম দ্বারা তাহাদের অন্নবস্ত্রের অভাব আংশিকরূপে দূর হয়, একসঙ্গে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পশুবধে তাহার রক্ত, হাড়, উদরস্থ গোবর ইত্যাদি সাররূপে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। এ জন্য কোরবানির পশুকে মাঠে লইয়া গিয়া জবেহ করার আদেশ দেওয়া হইয়াছে। [...] পশু পোষণ যাহাদের জীবনের প্রধান সম্বল তাহারা সারা বৎসরের মধ্যে এই পর্বোপলক্ষে পশু বিক্রি করিয়া নিজ নিজ সংসার জীবনের নানাপ্রকার অভাব অভিযোগ তদ্দারা মিটাইয়া থাকে।”
বিশ শতকের সেই প্রথম দশক থেকে ঈদ নিয়ে কবিতা, গান, গল্প, নাটক ও নাটিকা লেখার সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল। শেখ ফজলুল করিম, শাহাদাৎ হোসেন ও গোলাম মোস্তফা এই ধারার উল্লেখযোগ্য কবি। কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু সংস্কৃতি এবং পুরাণের আলোকে যিনি গান ও কবিতাকে জনজীবনের প্রাণের সম্পদ করে তুলেছিলেন, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। ঈদ নিয়ে রচিত তাঁর কিছু গান ও কবিতা লোকমুখে এতটাই উচ্চারিত হয় যে, তার আবেদন কোনো কালেই শেষ হবার নয়। তিনি প্রথাগত ছিলেন না। প্রবলভাবে নিজস্ব যে সুর তিনি তৈরি করেছিলেন, তার সঙ্গে একদিকে আছে ঈদের আনন্দধারা এবং অন্যদিকে মানুষের ঐক্য ও মুক্তির আকাক্সক্ষা। চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে মনে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সৃষ্ট হয়, নজরুল তার ভেতরগত রূপ ধরতে চেষ্টা করেছেন। এর পূর্বে এমনভাবে কেউ আর ভাবেননি, কারো কল্পনাপ্রতিভাই সৃষ্টির এই মহিমা লাভ করতে পরেনি। তিনি এককভাবেই ঈদ বিষয়ক গান ও কবিতার একটি আলাদা জগৎ তৈরি করে গেছেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাÑ এই দুই ঈদ নিয়েই নজরুল কবিতা, গান ও নাটক লিখেছেন। যেমন : ‘শহীদী ঈদ’, ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘বকরীদ’, ‘ঈদ-মোবারক’, ‘জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ’, ‘কোরবানি’, ‘আজাদ’Ñ এগুলো তাঁর ঈদের কবিতা। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘নতুন ঈদের চাঁদ’, ‘চলো ঈদগাহে’, ‘ঈদ ঈদ ঈদ’, ‘নাই হল মা বসন-ভূষণ এই ঈদে আমার’, ‘ছয় লতিফার ঊর্ধ্বে আমার আরাফাত ময়দান’, ‘ঈদুজ্জোহার তকবির শোনো’, ‘ঈদ মোবারক হো’, 'ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান’, ‘ফুরিয়ে এল রমজানেরই মোবারক মাস’, ‘নতুন চাঁদের তকবির, ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ’, ‘দে জাকাত দে জাকাত, তোরা দেরে জাকাত’, ‘ঈদ মোবারক হোক ঈদ মোবারক হোক’, ‘ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক’Ñ এগুলো হলো নজরুলের ঈদবিষয়ক গান। আর ‘ঈদজ্জোহা’ ও ‘ঈদুল ফেতর’ নামে আছে দুটি নাটিকা। ঈদুল ফিতরের পটভূমিতে রচিত “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটি জনপ্রিয়তা বিবেচনা করলেই বোঝা যায় যে, নজরুল ঈদের গান রচনায় কতটা জীবনঘনিষ্ট ও ধর্মীয় চেতনার অনুবর্তী ছিলেন। গানটির কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করি। “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।/ তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ,/ আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,/ যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।/আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,/ তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।”
এইসব গানে আবার মানুষের দারিদ্র্য এবং শোষণ-বঞ্চনার কথা গভীর মমত্বের সঙ্গে এসেছে আর ঘোষিত হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা। যেমন “জাকাত লইতে আসমানে এলো আবার ডাকাত চাঁদ/গরীব কাঙাল হাত পাত, ধনী রইস সবাই বাঁধ।” “প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী,/তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।” “সবাই খোরাক পাইবে ক্ষুধার আসিবে ঈদের খুশি,/লুট করে নে রে আল্লার দান কেউ হবি না রে দুষী।” এর মেধ্যে আবার আছে প্রতিবাদের কণ্ঠ। যেমন, “জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?”
ঈদুল আজহার পটভূমিতে নজরুল অনেকগুলো গান রচনা করেছেন। এইসব গানের মধ্যে একদিকে যেমন ত্যাগের মহিমাকীর্তন করা হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে মানুষের জেগে উঠার জয়গানও ধ্বনিত হয়েছে। যেমন, “‘শহীদান’দের ঈদ এলো বকরীদ!/অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে, তারি তরে এই ঈদ।.../উমরে, খালেদে, মুসা ও তারেকে বকরীদের মনে করো,/শুধু সালোয়ার পরিও না, ধরো হাতে তলোয়ার ধরো।” “পশু কোরবানি দিস তখন/আজাদ-মুক্ত হবি যখন/জুলুম-মুক্ত হবে বে দ্বীন।Ñ/কোরবানির আজ এই যে খুন/শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন, /জালিমের যেন রাখে না চিন।।/আমিন রাব্বিল আলামী/ আমিন রাব্বিল আলামীন!”
জিঞ্জীর কাব্যগ্রন্থের ‘ঈদ-মোবারক’ কবিতাটির স্বাদ, গন্ধ আর উচ্ছ্বাস ঈদের আনন্দকেও যেন ছাড়িয়ে যায়। “আজিকে এজিদে হাসানে হোসেনে গলাগলি,/ দোজখে ভেশতে ফুলে ও আগুনে ঢলাঢলি,/ শিরি ফরহাদে জড়াজড়ি।/ সাপিনীর মতো বেঁধেছে লায়লি কায়েসে গো,/ বাহুর বন্ধে চোখ বুঁজে বঁধূ আয়েশে গো!/ গালে গালে চুমু গড়াগড়ি।”
নজরুলের পরে এই শক্তিমান ধারাটি অব্যাহত থাকেনি। তবে ঈদ নিয়ে কবিতা, গান, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ লেখা অব্যাহত থেকেছে। সিকানদার আবু জাফর, ফররুখ আহমদ, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন, আহসান হাবীব, সানাউল হক, আজিজুর রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, মনোমোহন বর্মণ প্রমুখ কবিগণ ঈদ নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। ফররুখ আহমদের ‘ঈদের স্বপ্ন’ নামক সনেট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ চাড়া শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরীর থেকে শুরু করে প্রায় সকল কবি-সাহিত্যিক ঈদ নিয়ে রচনা করেছেন কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ও নাটক। বিশেষ করে ঈদের পটভূমিতে শিশুসাহিত্যের সমৃদ্ধ ভা-ার তৈরি হয়েছে। আর ঈদ নিয়ে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে ধারা তৈরি হয়েছে তার মূলে আছে নজরুলের চিরায়ত বাণী “ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান”।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.