|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
নওগাঁর ধামইরহাটে মাহীশন্তোষ বঙ্গ দেশে প্রথম মসজিদ নির্মাণ
প্রকাশের তারিখঃ ১০ মে, ২০২৩
ধামইরহাট নওগাঁ প্রতিনিধি:-
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ৩ নং আলমপুর ইউনিয়নের মাহীশন্তোষে বাংলাদেশের প্রথম মসজিদ নির্মাণ, বঙ্গ দেশে ইসলামের আগমন ও ধর্ম প্রচার কেন্দ্র ধ্বংসাবশেষ অবস্থিত।
বুধবার (১০-মে ) এই ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কথা হলে লেখক. প্রভাষক মো. আব্দুর রাজজাক রাজু' তিনি জানান,নওগাঁর ধামইরহাটের মাহীশন্তোষে বাংলাদেশের প্রথম মসজিদ নির্মাণ ধর্ম প্রচার কেন্দ্র ও তৎকালীন,প্রশাসনিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,শিক্ষা,কৃষি, সংস্কৃতি ও ইসলামের মহামুল্যবান বাণী প্রচারে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ স্হান ছিলো বলে ও তিনি জানান। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম যুগে তৈরি মসজিদগুলি ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করত। মসজিদের মধ্যে মক্তব স্থাপন করে মুসলমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হতো। কোরআন,হাদিসের প্রাথমিক পাঠ এবং আরবি, ফারসি ভাষায় হাতেখড়ি হতো এই সকল মসজিদেই। বলা বাহুল্য মাহীশন্তোষের মসজিদ গুলিও ইসলামী শিক্ষা,ও সংস্কৃতি বিস্তারে একই ধরনের ভূমিকা রাখত।
ধামইরহাটের মাহীশন্তোষে প্রথম মসজিদ নির্মাণ-দিনাজপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ভি,ওয়েষ্ট মেকড মাহীশন্তোষ থেকে দুটি শিলালিপি উদ্ধার করেন। শিলালিপি দুটির একটি বড় একটি ছোট। উদ্ধারের সময় বড় শিলালিপিটি মাহীশন্তোষ মাজারের ভিতরে দরজার উপরে লাগানো ছিল। লিপির পাঠোদ্ধারে জানা যায় যে রোকনউদ্দীন বারবাক শাহের (১৪৫৯-১৪৭৬) আমলে খানউল মোয়াজ্জেম উলুঘ একরার খান ৮৩৪ হিজরি সনে(১৪৬১খৃষ্টাব্দে) খানই মোয়াজ্জেম আশরাফ খানের মাধ্যমে এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
বলাবাহুল্য লিপিটির সঙ্গে মাজারের কোন সম্পর্ক নাই।দীর্ঘ দিন ধরে অনেক ঢিবি কাটার পরেও এখনো মাহিসন্তোষে যে ঢিবি আকারে অসংখ্য ইমারতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে উল্লেখিত মসজিদটি এর কোন একটি হয়ে থাকবে। সূত্র (আ,ক,ম,জাকারিয়া, বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ -পৃ ২৯৬)এই মাহিসন্তষে দ্বিতীয় মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে বলেন,দ্বিতীয় শিলা লিপিটির আংশিক পাঠ উদ্ধারে জানা যায় সুলতান রোকনউদ্দিন বারবাক শাহের শাসনামলে খানুল আজম উলুক খান ছিলেন বিখ্যাত বারবাকাবাদ শহরের উজির। তিনি ৮৭৬ হিজরী সনে (১৪৭১খ্রিস্টাঃ) এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।দিনাজ পুরের পীর চেহেল গাজীর মাজারের অভ্যন্তরে একটি ক্ষুদ্রায়তন প্রাচীন মসজিদের পূর্ব দেয়ালে দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ভি,ওয়েষ্ট মেকড,কর্তৃক উদ্ধারকিত শিলালিপি থেকে জানা যায় "জুড়" ও "বেরুর" এর শিকদার উলগ নসরাত খান উলুগ একরার খানেের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিলেন বলে উল্লেখ আছে। সূত্র (মো,মমতাজুর রহমান সম্পাদিত - বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রত্নকীর্তি, আ,ক,ম যাকারিয়া, প্রকাশঃ ১৯৯৮ পৃঃ২৯৮)দ্বিতীয় লিপিতে বারবাকাবাদ কে একটি বিখ্যাত শহর এবং প্রশাসন কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং উলুঘ একরার খানকে শহরটির উজির বলা হয়েছে। বারবাকাবাদে এতো বড়ো একজন কর্মকর্তার অস্তিত্ব থেকে শহরটির গুরুত্ব সহজেয় অনুমান করা যায়। (ড,রেজাউল করিম,প্রাচীন নগর মাহিসন্তোষ, পৃ ১০৮)
এই মাহিসন্তোষে তৃতীয় মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে বলেন,বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে প্রতিষ্ঠাতা কুমার শরৎকুমার রায় পরিচালনায় ১৯১৬ সালে মাহিসন্তোষ উৎখনন কালে তৃতীয় শিলা লিপিটি উদ্ধার করেন। খননে বিভিন্ন প্রস্তর মূর্তি ও একটি মেহেরাব আবিষ্কৃত হয়।মেহেরাবটি কালো পাথরের ও শিলালিপির দুই লাইনের ক্যালিও গ্রাফিতে লিখা পাঠোদ্ধারে জানা যায় সুলতান হোসেন শাহের আমলে ৯১২ হিজরী সনে (১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে) বিন সোহাইল কর্তৃক রমজান মাসে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।বিন সোহেলকে মনেকরা যেতেপারে যে তিনি মাহি সন্তোষে নিয়োজিত আলাউদ্দিন হোসেনসাহের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।(অক্ষয় কুমার মৈত্রিয় রচনা সমগ্র। সূত্র সম্পাদনা রাজনারায়ণ পাল,প্রকাশ -২০১২ পৃঃ ২০৩)মাহিসন্তোষে চতুর্থ মসজিদ নির্মাণ সম্পর্কে বলেন,সম্প্রতি রোকনুদ্দিন বাবারবাক শাহের আমলের মসজিদ নির্মাণের তথ্যসম্বলিত আরো একটি শিলা নিপি পাওয়া গেছে। মসজিদের ধ্বংস স্তুপ এর মধ্যে পাওয়া এই প্রত্নলিপিতে জনৈক উলুঘ হাবাস খান কর্তৃক ৮৬৭ হিজরী( ১৪৬২ খ্রিস্টাব্দে)এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ আছে। দুই সারির লেখনী বিশিষ্ট শিলালিপিটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরে এখনো সংরক্ষিত আছে।বরেন্দ্র জাদুকরে মহাপরিচাল অক্ষয় কুমার মৈত্রীয় ১৯১৩ সালে মাহিসন্তোষ ভ্রমণ করেন। তার মতে মুসলমান শাসকগণ এখানে একাধিক মসজিদ নির্মাণ করেন। মাহিসন্তোষ কমপক্ষে তিনটি মসজিদের অস্তিত্ব ছিল তার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া যায়। এর দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল সুলতান রোকনউদ্দিন বারবাকশাহ (১৪৫৯-১৪৭৬)এর আমলে। তৃতীয় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেনশাহের আমলে।
এতগুলো নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,এতগুলো মসজিদ নির্মাণের কারণ এমন,সুলতান রোকনউদ্দিন বরবাক শাহের রাজত্বকালে সরকার বারবাকাবাদের প্রধান নগর ছিল মাহিসন্তোষ। এ ছাড়া সেনানিবাস, টাকশাল স্হাপন, বৃহৎ মাদ্রাসা স্হাপন ও বহু মসজিদ নির্মাণ শহরটির বিশাল আয়োতন ও বিপুল জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি প্রমান করে। সূত্র
(গৌড় রাজমালা -অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়-পৃঃ ৪১)রাজা টোডরমলের রাজস্ব বিভাগ অনুসারে বারবাকা বাদ সরকারের মহল সংখ্যা ৩৮ রাজস্ব আদায় ১৭, ৪৫১,৫৩২ দাম" নিদৃষ্ট ছিলো। বৃহত্তর রাজশাহী জেলা, দিনাজপুর জেলা, ও পাবনা জেলা এই সরকারের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। বারবাকাবাদ সরকার প্রধান ৫০ টি অশ্বারোহী ও ৭,০০০ হাজার পদাতিক সেনা সরবরাহ করত। সূত্র (কাজি মিসের -রাজশাহির ইতিহাস- পৃঃ ২৯২)বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ১৯১৩ সালে মাহিগন্জ পরিদর্শন ও বিশ্লেষন করে তিনি বলেন- বঙ্গে স্বাধীন সুলতানদের আমলে মাহিসন্তোষ প্রশাসনিক,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,শিক্ষা, কৃষি, সংস্কৃতি ও ইসলামের মহামুল্যবান বাণী প্রচারে বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ স্হান ছিলো (ভারতের যাদুঘরে -পৃঃ ১৯)মসজিদের মূল অবকাটমো আবিষ্কার।
ড,ইয়াকুব আলী ও এ,বি, এম হোসেনের মতে-এখানে একটি বড় ধরনের মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে।প্রাচীন এই মসজিদটি মাটি থেকে তিন চার ফুট উঁচু অস্তিত্ব নিয়ে এখনো অনেকাংশ টিকে আছে। একে বারোদুয়ারী মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়েছে।আকার ও বৈশিষ্ট্য উন্মোচন এই প্রাচীন মসজিদটি উত্তর দক্ষিনে লম্বা আয়তাকার এর অভ্যন্তর ভাগের দৈর্ঘ্য ছিলো ৬৬ ফুট এবং প্রস্থ ছিল যথাক্রমে ৩৯ ফুট। ৭ফুট প্রসস্থ দেওয়াল এর সঙ্গে যুক্ত করলে মসজিদটির বহির্মাপ দাঁড়ায় ৮০×৫৪ ফুট। এর পূর্ব দেওয়ালে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে তিনটি করে দর্জা ছিলো।। মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে সমান দূরত্বে পাথর দিয়ে নির্মিত পাঁচটি মেহরাব ছিলো। অপূর্ব শিল্প শৈলীর একটি মেহরাব বরেন্দ্র যাদুঘরে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানান নওগাঁ জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য লেখক. প্রভাষক মো. আব্দুর রাজজাক (রাজু),ধামইরহাট নওগাঁ।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.