|| ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২১শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
সংসার সমরাঙ্গন -এর মূলতত্ত্ব আলোচনার পূর্বে সংসার সমরাঙ্গন বলতে কি বুঝায় তাহা জেনে নেই।
"সংসার সমরাঙ্গন "
সংসার শব্দের অর্থ হলো- জগৎ, পৃথিবী, ভব, ইহলোক, ইহজীবন, মর্ত্যলোক, গার্হস্থ্য জীবন, ঘরকন্না বা গৃহস্থালি বা বিবাহিত জীবন, পরিবার, মায়ার বাঁধন; পত্নী( পতি দ্বারা যে স্ত্রীলোক পরিচালিত হয়) ।
*সমরাঙ্গন* - এখানে দুটো শব্দ-
১। সমর, ২। অঙ্গন।
সমর শব্দের অর্থ হলো- যুদ্ধ,
অঙ্গন শব্দের অর্থ হলো- উঠোন বা ক্ষেত্র বা মাঠ।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম যে-
সংসার সমরাঙ্গন - এর অর্থ দাঁড়ায় - সংসার একটি যুদ্ধক্ষেত্র।
এখন প্রশ্ন হলো-বিজ্ঞ মহাজনেরা কেন এই মায়াময় সংসারকে যুদ্ধ ক্ষেত্রের সাথে তুলনা করলেন?
তারই উত্তর জানার জন্য আজ আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। জানিনা সকলের কেমন লাগবে।অনেক অনেক অভিজ্ঞ ব্যাক্তিগণ আছেন যারা অতিশয় জ্ঞানী মহাজন।সকলে আমার ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
*সংসার সমরাঙ্গন *
পিতার ঔরসে শুক্রাণু সুক্ষ্ম বীজাণু রূপে অবস্থান করে। যখন শুভক্ষণে পিতামাতার মিলন ঘটে, তখন লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু মায়ের গর্ভাশয়ে পতিত হয়। তখন থেকেই শুরু হয় সেই শুক্রাণু গুলোর প্রাণপণ যুদ্ধ বা এক বিশাল প্রতিযোগীতা।
শুক্রাণু গুলো কার আগে কে মায়ের গর্ভে গিয়ে নিষিক্ত হবে, তার জন্য চলে বিশাল যুদ্ধ বা ছুটে চলার প্রতিযোগিতা । পরিশেষে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দীর্ঘপথ ছুটে চলার সময় পথের মাঝেই ক্লান্ত হয়ে একে একে প্রায় সব গুলো শুক্রাণুই মৃত্যু বরণ করে।, শুধু মাত্র বাকী একটি শুক্রাণুই ছুটে চলার পথে বিজয়ী হয়ে মায়ের ডিম্বাণুতে আশ্রয় গ্রহণ করে। তারপর সেখানেই সূচনা হয় একটি নবপ্রাণের বা মানব জন্মের। এটা হলো জীবের প্রথম যুদ্ধ। এই প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মায়ের গর্ভে আত্মপ্রকাশের প্রথম সৃষ্টির সূচনা করে একটি মানব শিশু। তারপর থেকে প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করতে হয় বিভিন্ন প্রতিকূলতার সাথে বা কঠিন নরক যন্ত্রনার সাথে। এভাবে যুদ্ধ করতে করতে একদিন শুভক্ষণে ভূমিষ্ট হয় একটি পরিপূর্ণ মানব সন্তানের।
শিশুটির যখন মায়ের গর্ভে জন্ম হয়,তখন থেকেই শুরু হয় ধাপে ধাপে তার বেঁচে থাকার যুদ্ধ। তার সাথে সহযাত্রী হিসাবে থাকেন একজন মা, যিনি সেই শুক্রাণুটিকে গর্ভে ধারণ করে বড় করে ছিলেন এবং তার সাথে সহ্য করে ছিলেন অসহ্য মৃত্যু যন্ত্রণা। তিনিই হলেন সেই শিশুটির মমতাময়ী *মা*। গর্ভে বেড়ে উঠার জন্যও বিভিন্ন ভাবে প্রাণপণে সাহায্য করেন স্নেহময়ী মা সেই প্রথম যুদ্ধ বিজয়ী মানব শিশুটির জন্য।
তাহলে বুঝাই গেলো যে, একজন *মা*'ই হলো একজন মানব শিশুর প্রথম উত্তম বন্ধু। যিনি এই মানব শিশুটিকে পৃথিবীতে আসতে সাহায্য করেছিলেন। আর সেই মানব শিশুটির পিতাও অক্লান্ত পরিশ্রম করে- অর্থ দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে মা'কে সাহায্য করেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবার ভেবে দেখুন, সেই মানব শিশুটিই হলো - আমি, আপনি বা আমরা সবাই।
মানব শিশুটি যখন পৃথিবীতে আসে তখনও শুরু হয় তার বিভিন্ন প্রতিকূলতা বা নিজেকে বাঁচাবার লড়াই।সে লড়াইয়ের সঙ্গী হিসেবে থাকেন প্রথম বন্ধু পিতা-মাতা এবং পরবর্তী বন্ধু হলেন- দাদা,দিদা, কাকা, জেঠা, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা ইত্যাদি। তাই প্রত্যেকের সাহায্য ও সহযোগিতার কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।আবার এদের দ্বারাই বাজতে পারে মৃত্যু ঘন্টা এবং হতে পারে তার নিদারুণ মৃত্যু। অর্থাৎ মৃত্যু তার সাথে সাথে সর্বক্ষণ ছায়ার মত ঘুরাঘুরি করে। পদ্ম পাতার মধ্যে শিশির বিন্দু যেমন টলমল করে- ঠিক তেমনি করে আমাদের জীবনটাও টলমল করে এবং তা কখন যে ঝরে পড়ে যায় তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
এ ভাবেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চলে মহাসংগ্রাম। তার মধ্যে যদি তিনি নারী হন- তার পরিশ্রম করতে হয় ১৮ঘন্টা, আর যদি পুরুষ হন, তবে তার পরিশ্রম করতে হয় ৮ ঘন্টা। এই ১৮ ঘন্টা পরিশ্রম করার পরেও না খেয়ে না দেয়ে থেকে হাসি মুখে অপরকে বলতে হয় একজন নারীকে-
আপনি কেমন আছেন?
কিছু লাগবে আপনার?
শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এই সংসারকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।সম্ভব হয় না কাউকে কষ্ট দেওয়া।তাই মুখ বুঝে সব কিছু সহ্য করে যেতে হয়, সহ্য করে যেতে হয় সমস্ত কষ্ট জ্বালা যন্ত্রনা।আবার একজন পুরুষকেও এই মায়াময় সংসারকে পালনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হয় সারাটা জীবন। যদিও একটু সুখের সন্ধান পাওয়া যায়, আর বাকী সময়টাই চলতে হয় বেঁচে থাকার ঝুঁকি নিয়ে বা প্রতিটা সময়ই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়।বলতে গেলে তা মেঘে ঢাকা সূর্যের মত।
যুদ্ধে পরাজয় বরণ করলে মৃত্যু বরণ করতে হয়।আর জীবন যুদ্ধে যদি পরাজয় ঘটে, তবে মৃত্যু না হলেও বাকী জীবন বয়ে চলতে হয় - হতাশা, না পাওয়ার বেদনা, দুঃখ কষ্ট ইত্যাদি নিয়ে।
এ কারণেই হয়তো মায়াময় সংসারকে "সংসার সমরাঙ্গন " বলা হয়েছে।তাই হয়তো* সংসার সমরাঙ্গন* থেকে চির মুক্তির জন্য আমরা মহান ঈশ্বরের ভজনা করে থাকি।আর যদি এই দুঃখ কষ্ট না থাকতো, তবে হয়তো বা ঈশ্বরের ভজনা করা বা ধর্ম পালনের কোন দরকার ছিল না।
যেহেতু এই মায়াময় সংসারের দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করা সহজ নয়,তাই সংসার জীবনে বিজয়ী হবার জন্য অবশ্যই সত্য, নিষ্ঠা ও সংযমের সাথে আমাদেরকে বিহিত কর্ম করে যেতে হয় এবং পারি দিতে হয় সংসার নামক মহাসমুদ্র । যদি আমরা বস্তু নিষ্ঠ ভাবে সংসার জীবন পার করতে পাড়ি, তাহলেই হয়তো হতে পারবো
সংসার সমরাঙ্গনে'র শ্রেষ্ঠ বিজয়ী বীর ও মহামানব।
(ভুলত্রুটি মার্জনীয়)
কলমে-
শ্রীপবিত্র কুমার চক্রবর্তী
চাঁদপুর, বাংলাদেশ।
০৩/০৫/২০২৩