|| ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
মেট্রোরেলের স্বপ্নযাত্রার প্রথম চালক লক্ষ্মীপুরের মেয়ে মরিয়ম আফিজা
প্রকাশের তারিখঃ ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২
মরিয়ম আফিজার বিষয়ে আগেই পত্রিকায় পড়েছিলাম। ওর স্বপ্নের চকচকে মুখটার ছবিও দেখেছিলাম। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করি বলে তখনই ইচ্ছা জেগেছিল, ওকে নিয়ে কিছু লেখার।
কিন্তু অপেক্ষা করছিলাম সফলতার একটা ছবির। সেই ছবিটাই আজ এঁকে দিলেন মরিয়ম। যে ছবিটা একসময় আঁকা ছিল রোকেয়ার চোখে, যে বলেছিল ‘আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব।’ তার সময়টা এত কঠিন অবরোধের আর বাধার ছিল, তবু বলেছিলেন ‘আমরা সবই হইব’। পদ-পদবি মুখ্য নয়, রোকেয়া চেয়েছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত ‘নারীমূর্তি’ থেকে বের হতে এবং সমাজের নারীদেরও ‘নারীমূর্তি’র পূজা থেকে বের করে আনতে।
রোকেয়ার সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি এই ‘নারীমূর্তি’ ভেঙে মানুষের মূর্তিতে পৌঁছানোই নারীর মূল চ্যালেঞ্জ। নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নও এখানেই। হাজার বছরের প্রোথিত বোধ, হাজার বছরের তৈরি করা চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তি খুব সহজ নয়। যেমন সহজ নয় বিদ্যমান চিন্তার নাগপাশ থেকে মুক্তি, যেমন এটির সাড়া মেলে না নিজের ভেতর, তেমন সমাজের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোও প্রবল ঝুঁকি। কিন্তু কোনো কোনো সাহসী নারী এই ঝুঁকিটাই গ্রহণ করেছে। প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকি দিয়ে তারা মাথা তুলেছে।
মেট্রোরেলের স্বপ্নযাত্রার প্রথম চালক লক্ষ্মীপুরের মেয়ে মরিয়ম আফিজা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। গত বছরের ২ নভেম্বর ‘ট্রেন অপারেটর’ হিসেবে নিয়োগ পান মেট্রোরেলে। তারপর শুরু হয় নিজেকে গড়া। প্রথমে চট্টগ্রামের হালিশহরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনিং একাডেমিতে দুই মাসের প্রশিক্ষণ নেন। ঢাকায় নেন আরও চার মাসের প্রশিক্ষণ। তারপর জাপানে নেন সেফটিবিষয়ক প্রশিক্ষণ। এখনো উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মেট্রোরেলের ডিপোতে কারিগরি ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখানে মেট্রোরেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাপানের মিতসুবিশি-কাওয়াসাকি কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা তাকে দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ। অর্থাৎ এক বছর ধরে নানা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন মেট্রোরেলের একজন চালক হিসেবে।
এই পেশায় কেন এসেছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘মেট্রোরেল একটি নতুন বিষয়, এক নতুন স্বপ্ন। দেশের উন্নয়ন আর এই স্বপ্নের সঙ্গে নিজের নাম জড়াতেই এ পেশায় এসেছি।’
২৮ ডিসেম্বর দিনটি যেমন ছিল বাংলাদেশের জন্য এক স্বপ্ন পূরণের দিন, যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের একটি দিন, তেমনি আফিজার জন্যও ছিল এক বিশেষ দিন। বাংলাদেশ মেট্রোযুগে প্রবেশের এক মাহেন্দ্রক্ষণের নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, নারীর ক্ষমতায়নে যার ভূমিকা অনন্য, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চালক আফিজার সঙ্গে কথাও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। উত্সাহ দিয়েছেন, জানিয়েছেন অভিনন্দন। নিজেই বলেছেন, ‘তোমার মাস্ক খোলো, আমরা ছবি তুলব।’ নারীর এই চ্যলেঞ্জিং পেশায় আগমন আর এ ছবি বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে। এই ছবি আগামীর দিনে নারীর পথ চলায় প্রেরণা হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে প্রথম মেট্রোরেল চালনার পর তাই আফিজার উচ্ছ্বাস—‘দেশবাসী স্বপ্নপূরণের জন্য যেমন অপেক্ষায় ছিল, তেমনই আমাদেরও অনেক প্রস্তুতি ছিল। সবকিছু সফল হয়েছে আজকের মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর। প্রধানমন্ত্রী এই যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন, পুরো দেশবাসীর মতো আমিও অনেক গর্ব বোধ করছি। নারীরা এখন আর কোথাও পিছিয়ে নেই। প্লেনের পাইলট থেকে শুরু করে জাহাজের ক্যাপ্টেন সব ক্ষেত্রেই নারী অবদান রাখছেন। নারীরা দেশ চালাচ্ছে, ঘর চালাচ্ছে। করপোরেট সেক্টরও নারীরা চালাচ্ছে। সব সেক্টরে নারীরা সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যে স্বপ্ন ছিল, আমরা একটি ডিজিটাল ট্রান্সপোর্টের দিকে যাব, তার এ অংশ হতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’
একজন নারী হয়ে কেন এলেন এমন একটি পেশায়, এমন প্রশ্নের জবাবও খুব পরিষ্কার প্রকৌশলী মরিয়ম আফিজার কাছে, ‘কোনো পেশা শুধু পুরুষের বা শুধু নারীর, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। নারী এই কাজের জন্য বা এই কাজের জন্য নয়, এমন স্টেরিওটাইপ চিন্তা আমাদের ভাঙতে হবে।’
এই স্টেরিওটাইপ চিন্তা ভেঙেই বেরিয়ে আসছে নারী। শুধু মরিয়ম নন, মেট্রোরেলে আছেন আরও পাঁচ জন নারী চালক। নারীদের এই বিচিত্র ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় এগিয়ে আসায় চোখে আঙুল দিয়ে সমাজকে দেখিয়ে দেয়, নারী সব কাজের যোগ্যতা রাখে।
কোনো কোনো মানুষ স্বপ্ন দেখে সাধারণ থেকে বের হওয়ার। যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়েছি, সবার সাধারণ স্বপ্ন যখন একটা প্রথম শ্রেণির চাকরি, তখন আমাদের এক বন্ধু বলেছিল, ‘আমি সাধারণ জীবন থেকে বের হতে চাই।’ সেদিন চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলা আমাদের কাছে সে কথা কোনো বিশেষ অর্থ বহন করেনি। কিন্তু এখন বুঝি, সাধারণ থেকে বের হয়ে অসাধারণ কিছু হওয়ার নামই প্রকৃত স্বপ্ন। নারী একদিন প্রথা ভেঙে চার দেওয়াল ভেঙেছিল। তৈরি করেছিল তার স্বপ্নের আকাশ। সেই স্বপ্নের আকাশে সে এখন ডানা মেলে উড়বে, এটাই এখনের বাস্তবতা। ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। স্বপ্ন যত বড় হবে, ততই বড় হবে মানুষের পৃথিবী। নারীর স্বপ্নে, নারীর ক্ষমতায়নেই গড়ে উঠবে আগামীর নিরাপদ বিশ্ব, নতুন আরেক পৃথিবীর সন্ধান পাবে মানুষ, এটাই হবে আগামীর বাস্তবতা।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.