আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে বামদের খুব একটা প্রয়োজন বোধ করেনি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সংসদ সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি কমরেড রাশেদ খান মেনন।মঙ্গলবার (১৭ মে) বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির পাঁচ দশকের পথচলা কতটা বন্ধুর ছিল জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, এদেশে কমিউনিস্টরা কখনও অনুকূল পরিবেশে কাজ করতে পারেনি। সেই অবিভক্ত ভারতে যেমন ছিল, পা’কিস্তান আমলে আরও বেশি প্রতিকূল পরিবেশ ছিল।
পা’কিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার ফলে এ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী কমরেডদের অধিকাংশই দেশ ত্যাগ করে পশ্চিম বাংলায় চলে যান। আজকে যাদেরকে পশ্চিম বাংলার নেতা দেখছেন, কিংবা পূর্বে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই এ দেশ থেকে যাওয়া। আবার পাকিস্তান গঠনের প্রথম দিকে যারা এদেশে রয়ে যান, তারাও চরম নিপীড়নের শিকার হন।
দেশে বাম আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জেলহত্যা বলতে জাতীয় চার নেতাকে হ’
ত্যার বিষয়ে জানি, তবে তার আগেও ১৯৫০ সালে রাজশাহীতে জেল হত্যা ছিল আরও বেশি মর্মান্তিক।
তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রকাশ্যে সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে কমিউনিস্ট পার্টি কিছু দিনের জন্য প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছিল। তখন কমিউনিস্ট পার্টি সম্ভবত রায়সাহেব (রাইসা) বাজারে অথবা নয়া বাজারের দিকে অফিস করেছিল, সেই অফিসও কমিউনিস্ট পার্টি বেশি দিন রাখতে পারেনি, মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের কারণে। আইয়ুব আমলে কার্যত ভাষা আ’ন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে নতুন প্রজন্ম কমিউনিস্ট আ’ন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
ভাষা আন্দোলনের সময়কার অগ্রসেনানী যেমন আমাদের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুনির চৌধুরী, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এবং পরে যারা সিএসপি অফিসার হয়েছেন, তাদের অনেকেই কোনো না কোনো সময় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যু’ক্ত ছিলেন। আমার সব ভাইয়েরাও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিল। আইয়ুব খানের আমলেই কমিউনিস্ট পার্টি পুরোপুরি (আন্ডার গ্রাউন্ডে) গোপনে চলে যেতে হয়। ৬০ দশকে এসে আবার এটার উত্থান ঘটে। ৬০ দশকে আম’রা এক ঝাঁক তরুণ সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্ত হই বামপন্থি আন্দোলনে। কার্যত কমিউনিস্ট পার্টি যেটা কমরেড মনি সিংহের পার্টি বলে পরিচিত, এটার বিস্তৃতি ঘটে ৬০ এর দশকেই।
চীন-রাশিয়ার বিতর্ক এবং বাংলাদেশের বাম রাজনীতির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই বামপন্থী নেতা আরও বলেন, ৬০ এর দশকে চীন এবং রাশিয়ার মহা বিতর্কের প্রভাব কমিউনিস্ট পার্টিতে পড়ে। ভারতের নকশাল আন্দোলন, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রভাবও পড়ে দেশের বাম আন্দোলনে।
একটা বড় অংশ যারা এতদিন ধরে স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন, গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ে সবচেয়ে অগ্রণী ছিলেন, তারা আবার উল্টো লাইন গ্রহণ করে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেন। ফলে আমরা যারা ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি করেছিলাম, তারা মুক্তিযুদ্ধে একদিকে প্রবাসী সরকারেরও সহযোগিতা পাইনি, আবার অন্যদিকে ভারতেরও কোনো সহযোগিতা পাইনি। বরং আমাদের কিছু কম’রেডকে বহুদিন ভা’রতের জেলে থাকতে হয়েছে অথবা বর্ডারে মারা যেতে হয়েছে। আমরা আমাদের যোগ্যতা অনুসারে মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করি, দেশের অভ্যন্তরে থেকেই আমরা যুদ্ধ করি।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা ছিলেন, আমাদের বহু কমরেড মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার পর যখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেছিলেন, তখন যারা মস্কোপন্থী ছিলেন, তাদের চীনের বিরোধিতার কারণে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কারণে তারা কিছুটা আনুকূল্য পেলেন। কিন্তু আমরা যারা পিকিংপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলাম, যদিও আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সেটাকে পরিত্যাগ করেছিলাম, তারা সেই ধরনের কোনো আনুকূল্য পাইনি। ১৯৭২ সালে আমরা তাগিদ অনুভব করি, আমাদের এসব কমিউনিস্ট গ্রুপকে এক হয়ে একটা পার্টিতে আসা উচিত। যার ফলে আমরা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি লেলিনবাদি নামে যাত্রা শুরু করি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলেও আমাদের বহু কমরেডকে রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয়েছে, জীবন
বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলেও আমাদের বহু কমরেডকে রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে, আমাদের কর্মীকে বাঁচাতে হয়েছে। সুতরাং আম’রা কোনোদিন অনুকূল পরিবেশ পাইনি। জিয়ার আমলেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। ৯৬ সালে আমরা তুলনমূলক কিছুটা ভালো অবস্থায় ছিলাম। বিএনপি জামাতের বিরুদ্ধে আন্দোলনে আমরাই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলাম।
আওয়ামী লীগ অনেক বড় সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও যখন মাঠে নামার সাহস বা দাঁড়াতে পারেনি, তখন আম’রা খালেদা জিয়ার অপারেশন ক্লিন হার্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, আমরা বাংলাভাই এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, আর কেউ তখন দাঁড়ায়নি। এরপর আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে এসে বললেন, তারাই আসলেন, আসেন একত্রে হই, একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং একসঙ্গে সরকার গঠন করি, এই ভিত্তিতে আমরা, ১৪ দলের ঐক্য গড়ে তুলি।
২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা জয়ী হলাম। কিন্তু আগে যে বললাম, আমাদের পথ কখনই মসৃণ ছিল না। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে বামদের খুব একটা প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা হঠাৎ করেই দিলীপ বড়ুয়াকে মন্ত্রী বানিয়ে ভাবলো, একজনকেতো দিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যে সমান্তরাল সম্পর্ক থাকা উচিত ছিল, সেটা থাকেনি। আবার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে বিএনপি জামাত মাঠে নেমে গেল, তখন আমরাই