|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
পার্বত্য চট্টগ্রামের আগমনী বার্তায় জানান দিচ্ছে ফুটলো বিঝুঁর ফুল-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ৯ এপ্রিল, ২০২২
বাংলা নববর্ষের আগাম বার্তা নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে বিঝুঁর ফুল (ভাতজোরা ফুল) । এ বছরও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় জুড়ে ফুটেছে পাতা বাহা/ বিঝুঁ ফুল’ (ভাতজোরা ফুল)। এ ফুলগুলো ফুটলে পার্বত্য চট্টগ্রামের (পাহাড়ে) বসবাসরত প্রত্যেকটি আদিবাসীদের মনে বিঝুঁর উৎসবে আনন্দে মনে মন দোলা দেয়। আর নববর্ষের বরণোৎসবের আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা।
বয়োঃজেষ্ঠদের সাথে কথা বলে জানা যায় , বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতীয়দের প্রধান সামাজিক উৎসব "‘বিঝুঁ” ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, "ফুল বিঝুঁ" (১২ এপ্রিল), "মূল বিঝুঁ" (১৩ এপ্রিল বা চৈত্র সংক্রান্তি) ও ""গয্যা-পয্যা বিঝুঁ"" (১৪ এপ্রিল বা পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ) পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব এবং সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্প্রীতি বন্ধনের মিলনের মহোৎসব বা "বিঝুঁর আপ্যায়ন" অর্থাৎ ""বিঝুঁর উৎসব"" পালন করে থাকেন ।
"বিঝুঁর" উৎসবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রকৃতির এই ফুল (ভাতজোরা ফুল) দিয়ে নদীতে স্নান করে ভাতজোরা ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা করে , বাড়ী-ঘর সাজানো হয়, পুজা-প্রার্থনা-বন্দনাসহ সকল কাজে ব্যবহার হয় বলে এই ভাতজোরা ফুলকে বিঝুঁর ফুল বলা হয়েছে । তবে সম্প্রদায় ভেদে পার্বত্য চট্টগ্রামের দশ ভাষাভাষী এগারটি জাতিসত্ত্বা আদিবাসীদের এ ফুলের বিভিন্ন নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী সম্প্রদায়েরাও এ ফুলকে বলে ‘ভিউফুল’। চাকমা সম্প্রদায়েরা বলে ‘ভাতজোরা ভাতজোরা ফুল’, ত্রিপুরা সম্প্রদায়েরা বলে ‘কুমুইবোবা, মারমা (মগধ বা বুদ্ধ সময় কালীন মগধ রাজ্যের অধিবাসীদের বলা হয়েছে মগধবাসী) মগধ সম্প্রদায়ের ‘চাইগ্রাইটেং’, সাঁওতাল সম্প্রদায়েরা বলে ‘পাতাবাহা’ ফুল নাম বলেই চিনে। এ ঐতিহ্যবাহী বিঝুঁ ফুলের সংরক্ষণ বা রক্ষায় কেউ বাগান না করলেও চৈত্র মাসের বসন্তকালে বাড়ীর আশেপাশে বা বনে জঙ্গলে প্রকৃতির জাগতিক নিয়মে প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে । আপনারা যে কোন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের সবুজ শ্যামল বনভূমিতে বেড়াতে গেলেই এ ফুলগুলোর দেখা মিলবে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে এখন আর আগের মতো গাছ-বাঁশ না থাকায় এই সব ফুলের "পাতাবাহা" / "বিঝুঁ ফুল’" বা ভাতজোরা ফুল খুব কমই দেখা পাওয়া যায় ।
নববর্ষের আগের দুই দিন থেকে "ফুল বিঝুঁর"’ দিনে (১২ এপ্রিল) ‘পাতাবাহা / "বিঝুঁ’ ফুল বা "ভাতজোরা ফুল" দিয়ে নদীতে পূষ্পপূজা অর্চণা করা, বাড়ী-ঘর সাজানো হলেই ‘বিঝুঁ’র পরিপূর্ণতা পায়। তাই ‘ফুল বিঝুঁ’র দিনে ‘বিঝু’ ফুল" দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা (পাহাড়ীরা) পুরো ঘর সাজিয়ে রাখে। তবে ‘বিঝুঁ’ ফুল না পেলেও অন্যান্য ফুল দিয়েও বাড়ী-ঘর সাজানো হয়ে থাকে ।
পানছড়ি উপজেলার প্রবীন রাজনীতিবিদ বিশিষ্ট সমাজ সেবক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বকুল চন্দ্র চাকমা অতীতের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, শিশু-কিশোর বয়সে নববর্ষের ফুল বিঝুঁর দিনে ফুল সংগ্রহের জন্য খুব ভোরে উঠেই ফুল কুড়াতে যেতাম। তারপর পাতাবাহা / বিঝুঁ ফুল বা ভাতজোরা ফুল অথবা বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে পুরো বাড়ী-ঘর সাজিয়ে রাখতাম। কিশোর-কিশোরীরা ফুল দিয়ে মালা গেঁথে হাতে-গলায় পড়তো। কথিত আছে, ভাতজোরা ফুলের মালা গায়ে দিলে অনেক রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে ধারণা রয়েছে অনেকের । এখন তো আর সেই দিন নেই। মানুষ এখন বিঝুঁ নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি উৎসব কম করে থাকে । কারণ বিঝুঁর সময় আসতে না আসতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে সম্প্রীতি পরিবেশ কোন কোন সময় নষ্ট হয়।
সাঁওতাল পাড়ার মিলন সাঁওতাল বলেন, পাহাড়ে বৃক্ষশুন্য হওয়ার কারনে এখন আর আগের মতো ‘পাতাবাহা / বিঝুঁ ফুল’ পাওয়া যায় না। অব্যাহতভাবে বন উজার আর পাহাড় কাটার ফলে ভবিয্যতে এ ফুল পাওয়া খুবই কষ্ট সাধ্য হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ ফুলগুলো চিনবেও না। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্য এ ফুল সংরক্ষন করা অতীব প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাঙমা সার্কেল চীফ (চাঙমা রাজা) ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা শত শত বছর ধরে এ সংস্কৃতি লালন-পালন করে আসছেন। তাঁরা শুধু বর্ষবরণের উৎসব নয়, বর্ষবিদায়ের উৎসবকেও বেশ গুরুত্ব সহকারে উদযাপন করে থাকেন। পুরোনো বছর থেকে যে সব অর্জন করা হয়, যে সব সফলতা তা গ্রহণ করে থাকেন, এবং পাশাপাশি পুরোনো বছরের সেইসব দুঃখ-কষ্ট গ্লানি থাকে সেইগুলো মুছে ফেলে সুন্দর আর নতুন দিনের প্রত্যাশা করে থাকেন তাঁরা। তাই এই সব বিঝুঁর উৎসব বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
এস চাঙমা সত্যজিৎ
বিশেষ প্রতিনিধি
দৈনিক বাংলার অধিকার
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.