|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রথমবারে মতলবে পরীক্ষামুলক সুইটগ্রীন তরমুজ চাষে ব্যর্থ হলেও হতাশ হচ্ছেন না – কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আতাউর রহমান সরকার-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ৮ এপ্রিল, ২০২২
চাঁদপুর জেলার অন্যতম কৃষি অঞ্চল হিসাবে বিবেচিত মেঘনা-ধনোগোদা সেচ প্রকল্পের মতলব উত্তর উপজেলার পুরো অংশ জুড়েই এ সময়ে নিচু জমি গুলোতে বোরো ধান, উচু জমিতে ভুট্টা ও বিভিন্ন প্রকার সব্জি চাষ করেন কৃষকরা।
এরই মাঝে ব্যতিক্রম উদ্যেগ হাতে নেন তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আতাউর রহমান সরকার। তিনি বলেন আমি লক্ষ করি, মতলব উত্তরে তরমুজের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রতিবছরেই এ উপজেলায় কয়েকশ কোটি টাকার তরমুজ আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। তরমুজের প্রচুর চাহিদার দিকটি বিবেচনা করেই আমি নিজ উপজেলায় তরমুজ চাষ পরীক্ষণের পর কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গত বছরে এমন প্রকল্প হাতে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পড়াশোনা ও অন্যান্য ব্যস্ততার জন্য নিতে পারি নাই। তবে এ বছর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন স্যারের সাথে বিষয়টি আলোচনা করলে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় একটি পরীক্ষণ প্রদর্শনী স্থাপন করি। তবে জমিতে ফুলকপি থাকার কারণে প্রকল্প স্থাপনে একটু বিলম্ব হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জমি তৈরি মালচিং ফ্লিম বিছিয়ে সরাসরি বীজ রোপণ করি। কিন্তু বৃষ্টির কারণে শতভাগ বীজ অন্কুরোদগম না হওয়ায়, সিডলিং ট্রেতে উৎপাদিত চারা রোপণ করে গ্যাপ ফিলিং করি।
তারপরই শুরু হয় আন্ত পরিচর্যা। প্রথম দিকে চারা একটু নড়বড়ে থাকলেও বেশকিছু দিন পরই জমি সতেজতায় যে কেউ মুগ্ধ হতো। এসময় আমাকে সর্বক্ষণিক পরামর্শ ও সাপোর্ট দিয়েছেন ছেংগারচর পৌরব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রেদোয়ান আদনান সহ মতলব উত্তর এর মুষ্টিমেয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, মতলব উত্তর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন সহ উপপরিচালক চাঁদপুর মোঃ জালাল উদ্দীন সাহেব। সকলের পরামর্শে আমি জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা,ফেরোমন, হলুদ ট্রাপ ব্যবহার করি। আমার গাছগুলোর বৃদ্ধি ছিল সন্তোষজনক। প্রথম দিকে গাছের ফলগুলোতে আশার আলো দেখতে ছিলাম।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, মার্চ মাসের বৃষ্টি ও বৃষ্টি পরবর্তী খরায় ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে এবং পোকার আক্রমণে মরে যাচ্ছে পরীক্ষণমূলক তরমুজ প্রদর্শনীর গাছ গুলো। এরুপ পরিস্থিতি দেখার আগে ও পরে বিভিন্ন প্রতিকারমুলক প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থ্যা গ্রহন করেন কিন্তু কাজে দেয় নি। কোথাও কোথাও গাছ সবল থাকলেও নেই ফলন। এমন ফলন বিপর্যয়ে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আতাউর রহমান সরকার। তবে তিনি হতাশ নয়। এমন ঘটনাকে স্থানীয় কৃষিবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মনে করছেন। তারা আবহাওয়া উপযোগী ও আগাম বীজ বপনের পরামর্শ দিয়েছেন।
মূলত এ সময়ে সারা দেশেই তরমুজের ফলন বিপর্যয়ের অবস্থা বিরাজ করছে। তবে যারা অগ্রিম তরমুজ চাষ করেছে তাদের কেউ কেউ ভালো ফলন তুলতে পেরেছেন।
এদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষকরা জানান, গত এক দশকের বেশি সময় অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি তরমুজ বেশ ভালো উৎপাদন হয়ে আসছে। এর চাহিদাও প্রচুর। তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে কৃষক। কিন্তু গত বছর অল্প পরিসরে তরমুজে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দেখা দেয়। এতে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন কৃষক। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসে বৃষ্টি হলে অধিকাংশ জমিতে পানি জমে যায়। এর পরপরই দেখা দেয় খরা। খরায় বৃষ্টির পানি শুকানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতের তরমুজের গাছগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলের জমিতে লবণাক্ত বেড়ে গিয়েও ঝলসে যাচ্ছে গাছ। আবার কোথাও কোথাও দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। জমিতে গাছগুলো সবুজ ও বেশ ভাল গজালেও নেই ফুল বা ফল। কিছু কিছু স্থানে ফলন হলেও পরিমাণে কম ও আকারে অনেক ছোট হয়েছে। তরমুজ গাছে ছত্রাক ও ভাইরাস ও পোকার আক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন কোম্পানির কীট ও বালাইনাশক ব্যবহার করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না কৃষকরা।
তারা বলছেন, এখনই ক্ষেতের তরমুজ কাটার কথা ছিল। কিন্তু ফলন না হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। লাখ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে তরমুজে ব্যয় করে এখন ঋণের জালে সর্বশান্ত হওয়ার পথে।
এদিকে একই উপজেলার সুলতানাবাদ ইউনিয়ন ৩ নং ওয়ার্ড হাতিঘাটা টরকী গ্রামে প্রবাস ফেরত কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল মিয়ার জমিতে তাইওয়ানের হলুদ তরমুজের কিছু আশার আলো দেখতে পেলেও দেখা যায় বেশিরভাগ জমির তরমুজ গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। একই জমিতে বিভিন্ন অংশের গাছ মরে শুকিয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু শুকানোর পথে। কোন গাছে কোনো ফুল বা ফল নেই।
এভাবে সারাদেশে একরের পর একর জমির তরমুজ গাছ মরে যাচ্ছে। গাছের গোড়ার অংশ ভালো থাকলেও পাতা থেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করতে করতে শুকিয়ে আসছে গোড়া পর্যন্ত।
তবে অন্য চিত্র দেখা যায় ময়মনসিংহের ভালুকায় নতুন কৃষি উদ্যোক্তা মেহেদির জমিতে। তার তরমুজ ক্ষেতে দেখা যায় অন্য চিত্র। সেখানে সবল ও সবুজে ছেয়ে গেছে তরমুজ ক্ষেত। কিন্তু গাছে নেই কোনো ফুল বা ফল। সে ক্ষেতেরও কোনো কোনো অংশে গাছের পাতায় হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। পোকার আক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে লক্ষী পুর জেলার কয়েক জন কৃষক জানান, দীর্ঘ বছর ধরে তারা তরমুজ চাষ করে আসছেন। প্রতি বছর ভালো ফলন হওয়ার পাশাপাশি ভালো দামও পাচ্ছিলেন। এবছর তারই সুবাদে হাজার হাজার একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে একেকজন লক্ষাধিক টাকা খরচও করেছেন। স্থানীয় এনজিও থেকে লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন অনেকেই। তবে যদি তাদের তরমুজ ক্ষেতের তরমুজ ভালোভাবে হতো তাহলে তাদের এ ক্ষেত গুলো থেকে কয়েক লক্ষাধিক টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারতেন। এতে তারা সকল ঋণ পরিশোধ করে ভালো লাভবানও হতে পারতেন। কিন্তু চলতি মাসের বৃষ্টিতে তারা একদম শেষ হয়ে গেছেন। ওই কৃষকদের ভাষ্য মতে, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃষ্টিতে প্রথমে গাছগুলো সবুজ ও সুন্দর দেখা যায়। কিন্তু বৃষ্টির পর পরই যখন খরা দেখা দেয় তখনই তার গাছগুলোর পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে। বিভিন্ন বালাই নাশক কোম্পানির পরামর্শে তারা একাধিক বালাই নাশক ব্যবহার করেও কোনো প্রতিকার পাননি। দিন দিন ক্ষেতের গাছগুলো শুধু মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ মার্চ মাসের শেষের দিকে প্রথম দফায় তারা একেকজন অন্তত দুই লক্ষাধিক টাকার তরমুজ তুলতে পারতেন যা দিয়ে ঋণের টাকা শোধ করতে পারতেন । এমন অবস্থায় কি করবেন সেটাই ভেবে পান না।
কৃষিবিভাগ বলেন, ‘গত বছরই মূলত এ রোগের আক্রমন শুরু হয়। প্রথমত একই জমিতে একই ফসল বারবার করার কারণে এ রোগ আক্রান্ত হয়। এর বাহিরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করাও একটি বড় কারণ। কৃষকরা সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। তাছাড়া যে বীজ তারা ব্যবহার করেন তাও কোন কোন অঞ্চলের উপযোগি নয়। ফলে খুব দ্রুত ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ও পোকা জমিতে আক্রান্ত করতে সক্ষম হচ্ছে। তারা বলেন, এ মুহুর্তে এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। পোকার আক্রমণে কিছু টা অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা যায়। গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে জানান, তাদের দপ্তর ঘেকে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মাঠ সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। দেখা যায় নিচু জমিতে রোগের আক্রমন বেশি আর উচু জমিতে পোকার আক্রমণ। মূলত ক্রাউন ফ্রুট রুট রট নামক রোগ। যা পাতা থেকে শিকড় পর্যন্ত নষ্ট করে। ঢলে পড়া রোগও রয়েছে। এ বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে দাপ্তরিকভাবে দ্রুত জানানো হবে এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তারা।
তবে তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা মোঃ আতাউর রহমান সরকার বলেন, হতাশার কিছু নাই। এবার ব্যর্থ হলে ও আগামীতে আগাম তরমুজ চাষ করবো।যেকোনো ভাবেই হোক আমার প্রিয় মতলবে তরমুজ চাষ করে সফল হতে চাই। পরবর্তীতে সকল তরুণ উদ্যোক্তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে মতলবে তরমুজ আমদানি বন্ধ করে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে সারাদেশে বিপণন সহ বিদেশে রপ্তানি করতে চাই। এবিষয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতা সবসময় কামনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ সালাউদ্দিন বলেন, উদ্যোক্তা মানে ঝুকি নেয়া। যে ঝুকি না নিয়ে পুরাতন কৃষি কাজ করে সে কৃষক। উদ্যোক্তা ঝুকি নিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে। এর আগে মতলবে কিছু কৃষি উদ্যোক্তা ঝুকি নিয়েই ভূট্টা সফল করেছে। তারপর তা বর্তমানে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সফলতা প্রথমবার নাও আসতে পারে। তবে চেষ্টা করলে একবার সফল হওয়া যাবেই।
মতলব উত্তরে অনেকেই ফল বাগান করে, সব্জি করে লাভবান হয়েছে।
যারা বিদেশে যায়, বিদেশ থেকে আমদানি করে, বড় শিল্প গড়ে সবাই ঝুকি নেয়।
কেউ ঝুকি না নিলে কোন বিষয়ে বৈচিত্র্য আসতো না, কোন শিল্প গড়ে উঠতোনা।
আশা করি, যারা এবছর তরমুজ চাষ করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তারা অন্য বিষয়ে সফল হয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। পাশাপাশি আমরা তাদের পূর্ণবাসনে সবসময়ই কারিগরি সহযোগীতা দিয়ে যাবো।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.