|| ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
কমিটি বিলুপ্তি ও বহিষ্কারে পৃথক বার্তা দুই দলের-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ২০ জানুয়ারি, ২০২২
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন শেষ হলেও এর জের চলছে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে। ১৬ জানুয়ারি ভোটের দিনেই নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং এর অন্তর্গত সকল থানা ও ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ভোটের পরদিন বিলুপ্ত করা হয় মহানগর শ্রমিক লীগের কমিটি। আর ভোটের এক সপ্তাহ আগে ৮ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ভোট শেষ হওয়ার একদিন পরেই মঙ্গলবার বিএনপি দল থেকে বহিষ্কার করেছে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিকারী তৈমুর আলম খন্দকারকে। তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কাজ করা এবং নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকেও একইদিন দল থেকে বের করে দিয়েছে বিএনপি।
মেয়র পদে টানা তৃতীয়বারের মত সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয় এবং তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমুর আলমের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তার অনুসারীদের ভূমিকা- ইত্যাদি নিয়ে এখনও নানামুখী বিশ্লেষণ চলছে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে। তবে এই বিশ্লেষণকে ছাপিয়ে বর্তমানে মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নাসিক ভোটকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের স্থানীয় তিনটি সংগঠনের বিলুপ্তি ও বিএনপির তৈমুর-কামালকে বহিষ্কারের ‘অ্যাকশন’। দুটি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ছাড়াও সেখানকার নাগরিকসমাজ ও রাজনীতি সচেতন লোকদের মধ্যে আলোচনা চলছে- বিলুপ্ত আর বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে কি ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি? এই প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণে বহুমুখী আলোচনা চলছে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনেও।
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগ মনোনীত ‘নৌকা’ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হওয়ার পরেও দলের এবং অঙ্গ-সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের কারও কারও প্রকাশ্যে, গোপনে কিংবা কৌশলে বিরোধিতার বিষয়টি ভালোভাবে নেননি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। আইভীর পক্ষে কাজ না করলেও কিংবা বিরোধিতায় না থাকলেও যারা রহস্যজনকভাবে ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিলেন- তাদের ভূমিকাকেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সন্দেহের চোখে দেখেছে। ‘একতরফাভাবে’ কাউকে সমর্থন করতে গিয়ে ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থীর বিরোধিতা করাকে বরদাস্ত করা হবে না- আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে কার্যত এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। একইভাবে নির্বাচনের মাঠে একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক বলয় যেন ক্ষতির কারণ হতে না পারে, সেটি বিবেচনায় নিয়েও দলের স্থানীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছে দলটি। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে- ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের কমিটি বিলুপ্তির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জকে দিয়ে সারাদেশেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই বার্তাটি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
নাসিক নির্বাচনের পরদিন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে মতবিনিময় করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির কাছে যে লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছিল, সেটির অন্যতম ছিল- আগামীতে সকল নির্বাচনে তথ্য-প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার নিশ্চিত করা। রাজনীতি ও নির্বাচন বিশ্লেষকদের ধারণা, ক্ষমতাসীনদের এই প্রস্তাব থেকে একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে, দলটি আগামীতে সব নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পক্ষে। রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া আওয়ামী লীগের এই প্রস্তাবকে ঘিরে বিশ্লেষকরা বলছেন, সূত্র মেলালে বলা যেতে পারে যে- নাসিক নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের কাছে একটি টেস্ট কেস ছিল। পুরো ভোট ইভিএমে হলে এবং দলের স্থানীয় সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ‘নৌকা’র প্রার্থীর পক্ষে থাকলে ফলাফল কেমন দাঁড়ায়- সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। তবে এক্ষেত্রে নাসিক নির্বাচনে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের বিরোধিতায় স্পষ্ট ধারণা পায়নি দলটি। ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের স্থানীয় কমিটি বিলুপ্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে দলের ভবিষ্যৎ কঠোর অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এদিকে, তৈমুর আলম খন্দকারকে বিএনপির বহিষ্কারের বিষয়ে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানান- বর্তমান সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের আর কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এমনকি এ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তৈমুর আলম মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির সেই অবস্থান জাতীয়ভাবে কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে দলের চেইন অব কমান্ড ধরে রাখার স্বার্থেই তৈমুরকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা এ-ও জানান, বিএনপি শুরু থেকেই ইভিএমের বিরুদ্ধে। কিন্তু নাসিক নির্বাচন হয়েছে ইভিএমে। নির্বাচনটি দৃশ্যত কম ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে বলে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীনরা ইভিএমের পক্ষে এক ধরনের জনমত সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করতে পেরেছে। বিএনপির নেতাদের মতে, তৈমুর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় নাসিক নির্বাচনটি জমে উঠেছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে বলে প্রচারণা চালানোর সুযোগ বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ। ভবিষ্যতে কেউ যেন দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে না পারেন, তৈমুরকে বহিষ্কারের মাধ্যমে দলের সারা দেশের নেতাদের সেই বার্তা দিতে চেয়েছে বিএনপি।
বিএনপির কারও কারও মতে, তৈমুর আলমের প্রার্থী হওয়ার পেছনে ভিন্ন কোনো কৌশলও কাজ করেছে। যার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় তৈমুরের বহিষ্কারাদেশে। সেখানে বিএনপির পক্ষ থেকে লেখা হয়েছে, ‘দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিএনপির গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পদ থেকে তৈমুর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার করা হলো’। ‘সুস্পষ্ট অভিযোগ’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে জানতে চাইলে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা ইত্তেফাককে জানান, তৈমুর কাদের সিদ্ধান্তে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন সেবিষয়ে বিএনপির কাছে তথ্য রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালের বহিষ্কারাদেশেও বিএনপি একই অভিযোগ এনেছে।
যদিও মঙ্গলবার বহিষ্কারের পরপরই তৈমুর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জে বড় দুটি রাজনৈতিক দলে (বিএনপি-আওয়ামী লীগ) কমিটি ভাঙা ও বহিষ্কারের মড়ক লেগে গেছে। এই বড় দুই দলের ত্যাগী ও নিবেদিত নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে শবিনা খতম পড়াইতে হবে। এটা করোনার মতো, রাজনৈতিক মহামারি লেগে গেছে। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য দুই দলেরই জালালি খতম পড়াইতে হইব।’
আর গতকাল বুধবার তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ শহরের মাসদাইর এলাকায় নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বহিষ্কার করলেও আমি দল পরিবর্তন করব না, অন্য কোনো দলেও যোগ দেব না। দলের একজন অনুগত কর্মী হিসেবে কাজ করে যাব। দল আমাকে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে মুক্তি দিয়েছে। এখন আমার সামনে দুটি কাজ- একটি হল, যাকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করি, সেই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিত্সার জন্য এবং ভোট ডাকাতির মেশিন ইভিএমের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা।’ তিনি বলেন, আমি ভাবতেও পারিনি দলীয় মহাসচিবের কথা কচু পাতার পানিতে পরিণত হবে। কারণ, মহাসচিব বলেছিলেন- ‘দলগতভাবে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না, কিন্তু কেউ ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় নির্বাচনে গেলে দলের কোনো আপত্তি থাকবে না।’ তৈমুর বলেন, কেন্দ্র বা দল থেকে আমাকে একবারের জন্যও নির্বাচন করতে নিষেধ করা হয়নি। তাহলে বোঝা যায় যারা নয়াপল্টন অফিসে বসে নারায়ণগঞ্জের নেতাদের আমার নির্বাচনে যেতে নিষেধ করেছিল তারা অবশ্যই চেয়েছিল ভোটটা নৌকায় পড়ুক।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকে বহিষ্কার প্রসঙ্গে তৈমুর বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে যা করার করেছে, কিন্তু এটিএম কামালের মত নেতাকে বহিষ্কার করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ, বিএনপি করতে গিয়ে ত্যাগী নেতা এটিএম কামাল বহুবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। আরেকজন এটিএম কামাল সৃষ্টি করা নারায়ণগঞ্জে খুবই কঠিন হবে।’
প্রসঙ্গত, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নাসিক নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর গত ৩ জানুয়ারি তৈমুরকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ এবং নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন তার প্রাথমিক সদস্য পদ ছিল। ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াত্ আইভীর কাছে ৬৬ হাজার ভোটে হারেন তৈমুর।
এদিকে, বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় এটিএম কামাল বলেছেন, ‘আমি জিয়াউর রহমানের আদর্শের সৈনিক। সেই আদর্শ থেকে কেউ সরাতে পারবে না। এতদিন দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ নিয়ে রাজপথে ছিলাম, এখন সাধারণ সমর্থক হিসেবে থাকবো। আমৃত্যু দলের জন্য কাজ করে যাব।’
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.