|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
ভারতে চাকরি সংকট ভয়াবহ জনজীবন-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ৯ জানুয়ারি, ২০২২
ভারতে চাকরি সংকট সরকারি হিসাবের চেয়েও ভয়াবহ
ভারতে গত সপ্তাহে গাড়িচালক হিসেবে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন আইনে স্নাতক এক ব্যক্তি। নাম জিতেন্দ্র মৌর্য। তবে তিনি একা নন, মধ্য প্রদেশে স্বল্প-দক্ষতার ওই ১৫ পদে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন। স্নাতকোত্তর, প্রকৌশলী, এমবিএ- কে নেই সেই তালিকায়। এমনকি, যে জিতেন্দ্রর কথা বলা হলো, তিনিও বিচারক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কিন্তু আবেদন করেছেন গাড়িচালক হওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে জিতেন্দ্র স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, পরিস্থিতি এমন যে, অনেক সময় বই কেনার টাকাও থাকে না। তাই ভাবলাম, আর কোনো কাজ করা যায় কিনা।
জিতেন্দ্র মৌর্যের এই অবস্থা দেখে ভারতে চলমান চাকরি সংকটের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য অনেকদিন থেকেই সময়টা ভালো যাচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তারা। এখন চাহিদাবৃদ্ধি আর সরকারি প্রণোদনায় ভর করে অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করলেও চাকরির বাজার এখনো মন্দা।
স্বাধীন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে ভারতে বেকারত্বের হার প্রায় আট শতাংশ ছুঁয়েছে। ২০২০ সাল এবং ২০২১ সালের বেশিরভাগ সময়জুড়ে এর হার সাত শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেন, অন্তত গত তিন দশকে ভারতে এমন কিছু দেখা যায়নি। এমনকি, ১৯৯১ সালের বিশাল অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও নয় (ওই বছর মন্দার সময় ভারত সরকারের হাতে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত ডলারও ছিল না)।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে বেশিরভাগ দেশেই বেকারত্ব বেড়েছে। কিন্তু ভারতে বেকারত্বের হার বাংলাদেশ (৫ দশমিক ৩ শতাংশ). মেক্সিকো (৪ দশমিক ৭ শতাংশ) ও ভিয়েতনামের (২ দশমিক ৩ শতাংশ) মতো উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে।
কমেছে বেতনভোগী চাকরির সংখ্যাও। প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকের সংখ্যা ও ব্যয় কমাতে মহামারিকে ব্যবহার করা এই সংকটের আশিংক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে সিএমআইই।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে লকডাউনের সময় ১৫ থেকে ২৩ বছর বয়সী তরুণ কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতিবিদ অমিত বাসোল বলেন, আমরা দেখেছি, লকডাউনের আগে যারা বৈতনিক চাকরি করতেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই এ ধরনের কাজ ধরে রাখতে পারেননি।
তবে ভারতের চাকরি বাজারে এমন গভীর সংকটের জন্য দায়ী শুধু করোনা মহামারিই নয়। কৌশিক বসু বলেন, ভারতের ঘটনায় স্পষ্ট যে, শ্রমিক এবং ছোট ব্যবসার কল্যাণে খুব সামান্য মনোযোগ দিয়ে নীতি প্রণয়ন হচ্ছে, যেমনটি আমরা ২০২০ সালে লকডাউনের সময় দেখেছি।
বেকার আসলে কত?
অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারি হিসাবে বেকারত্বের হার কর্মহীনদের প্রকৃত সংখ্যা বোঝাতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ। কারণ, সরকারি হিসাবে যে তথ্য দেখানো হচ্ছে, তা মূলত আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরির আশায় ঘোরা শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা। অথচ ভারতের ৯০ শতাংশ শ্রমশক্তিই অনানুষ্ঠানিক খাতের, অর্থনৈতিক ফলাফলে যাদের অবদান প্রায় অর্ধেক।
শ্রম অর্থনীতিবিদ রাধিকা কাপুর বলেন, বেকারত্ব এমন একটি বিলাসিতা, যা শিক্ষিত ও তুলনামূলক সচ্ছল ব্যক্তিরা বহন করতে পারেন। দরিদ্র, অদক্ষ বা আধা-দক্ষ মানুষেরা নয়।
যে ব্যক্তি যত বেশি শিক্ষিত, তত বেশি সম্ভাবনা থাকে যে, তিনি বেকার থাকবেন এবং স্বল্প-বেতনের অনানুষ্ঠানিক চাকরি নিতে চাইবেন না। অন্যদিকে, দরিদ্ররা, যাদের শিক্ষার সুযোগ খুব কম, তারা সামনে যে কাজই আসুক না কেন, করতে বাধ্য হন। সুতরাং, সরকারি হিসাবে বেকারত্বের হার অর্থনীতিতে শ্রমশক্তির পুরো চিত্র তুলে ধরছে না।
নেই পর্যাপ্ত আর্থিক নিরাপত্তা
ভারতের মোট শ্রমশক্তির তিন-চতুর্থাংশই স্বনির্ভর, যাদের সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা নেই। মাত্র দুই শতাংশের বেশি কিছু কর্মী সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় রয়েছেন। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে তারা অবসর সঞ্চয় স্কিম, স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, তিন বছরের বেশি লিখিত চুক্তির সুবিধা পান। মাত্র নয় শতাংশের কাছে অন্তত একটি সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাসহ আনুষ্ঠানিক চাকরি রয়েছে।
ড. রাধিকা বলেন, ভারতে শ্রমশক্তির অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ এবং একটি অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে রয়েছে।
তাদের আয়রোজগারও কম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেতনভোগী কর্মীদের ৪৫ শতাংশ মাসে ৯ হাজার ৭৫০ রুপির (১১ হাজার ২২৪ টাকা প্রায়) কম আয় করেন। অর্থাৎ তাদের দৈনিক আয় মাত্র ৩২৫ রুপি, যা ২০১৯ সালে প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরির চেয়েও কম।
অর্থনীতিবিদদের মতে, উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ভারতে বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ হলো কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমবর্ধমান পরিষেবা অর্থনীতিতে ঝুঁকে পড়া। ভারতের মতো বিশালাকার আর কোনো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উৎপাদনের বদলে সেবা-নির্ভর নয়।
ভারতের প্রবৃদ্ধিতে শক্তি জোগাচ্ছে মূলত সফটওয়্যার ও আর্থিক সেবা খাত, যেগুলো পরিচালিত হয় অতিদক্ষ কর্মী দিয়ে। দেশটিতে এমন খাত বা কারখানা বেশ কমই রয়েছে, যেখানে বিপুল সংখ্যক অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ কর্মী কাজ করতে পারেন।
ড. অমিত বাসোলের মতে, এই সংকট কাটাতে ভারত সরকারকে এখনই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ২০ শতাংশ পরিবারের জন্য নগদ অর্থ সরবরাহ এবং চাকরির নিশ্চয়তা স্কিম চালু করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ হলো, সব শ্রমিকের মৌলিক ন্যূনতম মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এগুলো না হওয়া পর্যন্ত দেশটির চাকরি বাজারে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসবে না।
সূত্র /বিবিসি
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.