|| ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
সুবর্ণচরে কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে খেজুর রস-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১
খেজুরগাছ, শীতের সঙ্গে রয়েছে যার নিবিড় সম্পর্ক। শীতকালে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরগাছ থেকে পাওয়া যায় সুমিষ্ট রস, গুড়। ফল হিসেবেও খেজুরের জুড়ি নেই। শীতের মিষ্টি রোদে খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি খেতে কে না ভালোবাসে?
কিন্তু বর্তমানে খেজুর গাছের কদর নেই। এ গাছকে ঝোপঝাড়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কোথাও-বা ইটভাটার উৎকৃষ্ট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শীতকালে গাছিরা আর যান না তার কাছে। দা-কাঁচি, একগাছি রশি, একদণ্ড বাঁশ ও কোমরে ঝোলানো লম্বা-গোল আকৃতির বিশেষ পাত্র (ঠুঙ্গি) নিয়ে গাছে উঠতে দেখা যায় না গাছিদের। শীতের প্রত্যুষে কাঁধে ভার চেপে ঝুলন্ত কলস নিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেলে তাঁদের ছুটতে দেখা যায় না, হাল আমলে।
কিছুদিন আগেও হেমন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গাছ কাটার প্রাথমিক কাজগুলো করার হিড়িক পড়ত। গায়ের পথে-ঘাটে, নদী বা পুকুরপাড়ে, বড় রাস্তার দুধারে বা খেতের আইল ঘেঁষে শত শত গাছের শীর্ষভাগ বিশেষভাবে কাটতেন গাছিরা। ১৫-১৬টি পাতা রেখে গাছের উপরিভাগের বাকলসহ অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিষ্কার করতেন। আড়াআড়িভাবে বাঁধা বাঁশের দণ্ডে দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে রশি পেঁচিয়ে ধারালো দা দিয়ে গাছিদের গাছ চাঁছা বা কাটার দারুণ দৃশ্য এখন তেমন চোখে পড়ে না।
নোয়াখালী সুবর্ণচর উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে শীতের সকালে এক দশক আগেও চোখে পড়তো রসের হাড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য। শীতের মৌসুম শুরু হতেই বাড়ি বাড়ি চলতো খেজুরের রস কিংবা রসের মিঠাই দিয়ে মজাদার পিঠাপুলির আয়োজন।
তবে সুবর্ণচরে এ দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এর প্রধান কারণ বিভিন্ন কারণে খেজুর গাছ নিধন। এতে দিনে দিনে সুবর্ণচরে কমছে খেজুরের গাছ। দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খেজুরের রসও।
তুলনামূলকভাবে সুবর্ণচরের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে খেজুর গাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কিছু গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই খেজুরগাছ আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। যে হারে খেজুরগাছ নিধন হচ্ছে সে তুলনায় রোপণ করা হয় না।শীত মৌসুমে সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে শেষ করা যাবে না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে শীত মৌসুমের গ্রামাঞ্চলে রসের ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শুধু খেজুরের রসই নয়, এর থেকে তৈরি হয় গুড় ও প্রাকৃতিক ভিনেগার। রস আর গুড় ছাড়া আমাদের শীতকালীন উৎসব ভাবাই যায় না। সুবর্ণচর উপজেলার ৫নং চরজুবিলী ইউনিয়নের সমাজসেবক,হাজী আব্দুল হক চৌধুরী বলেন, কাঁচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনো ভুলতে পারি না। তিনি জানান, গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এক সময় সুবর্ণচর উপজেলা খেজুর রসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখন গাছ যেমন কমে গেছে তেমনি কমে গেছে গাছির সংখ্যাও। ফলে প্রকৃতিগত সুস্বাদু সে রস এখন আর তেমন নেই। তবুও কয়েকটা গাছের পরিচর্যা করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে গাছিরা। খেজুরের গাছ কমে যাওয়ায় গাছির চাহিদাও কমে গেছে। আগে এই কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতেন গাছিরা। দক্ষিণ চরমহিউদ্দিন গ্রামে যে কয়েকটা খেজুর গাছ আছে তা বুড়ো হয়ে যাওয়ায় রস তেমন পাওয়া যায় না। রস বাজারে বিক্রির মতো আগের সেই অবস্থা নেই। তিনি জানান, এইতো কয়েক বছর আগে এক হাড়ি খেজুর রস বিক্রি হতো২০ টাকায়। এখন খেজুর গাছ না থাকায় সে রসের দাম বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। জানা গেছে, ইটের ভাটায় ব্যাপকভাবে খেজুর গাছ ব্যবহার করায় এ গাছ কমে গেছে। খেজুর গাছ সস্তা হওয়ায় ইটের ভাটায় এই গাছই বেশি পোড়ানো হয়। এছাড়া অনেক সময় ঘরবাড়ি নির্মাণ করার জন্য খেজুরের গাছ কেটে ফেলা হয়। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে খেজুর গাছ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার চরজব্বার ইউনিয়ন, চরজুবিলী ইউনিয়ন,চরবাটা ইউনিয়ন, চরআমানুল্যাহ ইউনিয়ন, চরওয়াপদা ইউনিয়ন, মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন ও চরক্লার্ক ইউনিয়নে মানুষের ঘর-বাড়ি নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে খেজুরের গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই কমে যাচ্ছে। কিন্ত গত কয়েক বছর পূর্বেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুরগাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালী গুড় বিক্রি করে বিপুল অংকের টাকাও আয় করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। খেজুর রস দিয়ে শীত মৌসুমে পিঠা ও পায়েস তৈরির প্রচলন থাকলেও শীতকালীন খেজুরগাছের রস এখন পাওয়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.