|| ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ২০শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
এক বছর ক্যাসিনোবাজরা প্রকাশ্যে থেমে নেই টেন্ডারবাজি-দৈনিক বাংলার অধিকার
প্রকাশের তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
এক বছর আগে সারা দেশে শুদ্ধি অভিযান চলাকালে ক্লাবগুলোতে চলা ক্যাসিনোতে হানা দেয় র্যাব-পুলিশ। অভিযানে গ্রেফতার হয় ক্যাসিনোবাজরা। এর জের ধরে শুরু হয় টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান। গ্রেফতার হন গণপূর্তের টেন্ডারবাজ জি কে শামীম। তিন মাস পর এই শুদ্ধি অভিযান থেমে গেলে অভিযান চলাকালীন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতে আত্মগোপনকারী ক্যাসিনোবাজ ও টেন্ডারবাজরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করেন। অনেকেই জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এসে আবারও শুরু করেন টেন্ডারবাজি। গণপূর্ত, রেলওয়ে, সিটি করপোরেশন, ওয়াসাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজির অভিযোগ আসে।
২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর প্রথম দিনই ফকিরাপুলের ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ৬ অক্টোবর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সীমান্ত এলাকা থেকে র্যাব গ্রেফতার করে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে। শুদ্ধি অভিযানের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে গণপূর্তের ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের টেন্ডার বাণিজ্য। জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ গণপূর্তের ৩ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন গ্রুপের কাজের টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। গ্রেফতার হন মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক মো. লোকমান হোসেন ভূইয়া, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনাকারী এনামুল হক আরমান, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর প্রধান সমন্বয়কারী সেলিম প্রধান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, মোহাম্মদপুরের ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব এবং ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আওয়ামী লীগের নেতা ময়নুল হক ওরফে মনজু। ক্যাসিনো অভিযান শুরুর পর অনেকেই গা ঢাকা দেন। কেউ কেউ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে আত্মগোপন করেন। প্রায় তিন মাস ধরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাব সিলগালা করে দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় ‘জুয়া খেলার’ অপরাধে একটিও মামলা হয়নি। সব মামলা হয়েছে মাদক, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে। জুয়া খেলা বন্ধে প্রচলিত আইনটি ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো। ঐ আইনে ‘ক্যাসিনো’ বলে কোনো শব্দই নেই। এ কারণে আইনটির কোনো কার্যকারিতাও নেই। ক্যাসিনো বন্ধে ৪৯ অভিযান :
ক্যাসিনোবিরোধী মোট ৪৯টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৩২টি র্যাব এবং ১৭টি অভিযান পুলিশ পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ২৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ২২২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময়ের মধ্যে ১১টি ক্যাসিনো ও ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে র্যাব।
ক্যাসিনোবাজরা প্রকাশ্যে : অভিযান শেষ হওয়ার পরে দেশে ফেরেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, কেন্দ্রীয় সদস্য মিজানুর রহমান, ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম সোহেল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের ইজারাদার আলী আহমেদ ও গুলিস্তান এলাকার দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ অন্তত ৩০-৩৫ জন। অভিযানে গ্রেফতার হওয়া কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জামিনে বেরিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব তলব করে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিন সংসদ সদস্যসহ ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
থেমে নেই টেন্ডারবাজি : শুদ্ধি অভিযানে গণপূর্তের টেন্ডারবাজ জি কে শামীম ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গণপূর্তের টেন্ডারবাজির অভিযোগ আনা হয়। এরই জের ধরে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে শুদ্ধি অভিযান চলে। টেন্ডারবাজির অভিযোগে যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ কয়েকটি পদে পরিবর্তন আনা হয়। এর পরও টেন্ডারবাজি থেমে নেই। সম্প্রতি গণপূর্তের অধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পে রূপপুর গ্রিনসিটি রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সের ১৬টি ভবনের আসবাবপত্র সরবরাহে ৫৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার কাজ বড় দুটি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট নিয়মের মূল্য দেখিয়ে টেন্ডার দাখিল করে। এর পরও বেশি মূল্যে দাখিল করা আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ঐ কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই টেন্ডার-প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। গণপূর্তে এ ধরনের টেন্ডারবাজির ঘটনা থেমে নেই। গণপূর্তের একজন শীর্ষ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা ওয়াসায় সম্প্রতি একজন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজির অভিযোগ উঠেছে। ঐ প্রকৌশলী তার স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ৪০ লাখ টাকার কাজ করার অভিযোগ উঠেছে।
২১ মামলায় চার্জশিট : ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের ঘটনায় দায়ের করা হয় ৫২টি মামলা। এর মধ্যে ১৪টি মামলার তদন্ত করে র্যাব। ১৩টি মামলার চার্জশিট আদালতে প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া এখনো একটি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। বাকি ১৮টি মামলা তদন্ত করে পুলিশ। পুলিশের তদন্ত করার মামলাগুলোর মধ্যে আটটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। এছাড়া ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে ২৭ জনের বিরুদ্ধে দুদক ২২টি মামলা দায়ের করেছে। এসব মামলার বিষয়ে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমরা মামলাগুলো তদন্ত করে শিগিগর চার্জশিট দেব।’
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গতকাল বলেন, ক্যাসিনো অভিযানের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে ১৩টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একটি মামলার তদন্ত চলছে। শিগিগর চার্জশিট দেওয়া হবে।
Copyright © 2024 দৈনিক বাংলার অধিকার. All rights reserved.